গাইবান্ধা প্রতিনিধি: গাইবান্ধার জনসভায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে স্বাধীনতার পক্ষের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে যে কোন ধরণের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড রূখে দাঁড়ানোর আহবান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ হিংসা-হানাহানি, মারামারি-কাটাকাটি বা সহিংসতা চায় না। দেশের মানুষ শান্তি চায়, গণতান্ত্রিক পরিবেশ চায়। বিএনপি নেত্রী আন্দোলনে সফল হতে পারেননি, আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেননি। আন্দোলনে সফল না হলেও খালেদা জিয়া আন্দোলনের নামে ব্যাপক সহিংসতা-নাশকতা, নৃশংস কায়দায় পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, মানুষের বাড়ি-গাড়ি, স্কুল-কলেজ পুড়িয়ে দেয়া, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন এমনকি নিরীহ গরুকে পুড়িয়ে মারতে সফল হয়েছেন। কিন্তু এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ড আর সহ্য করা হবে না। সংখ্যালঘুদের ওপরসহ দেশের বিভিন্নস্থানে যারা এসব সহিংসতা-নাশকতা চালিয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তমুলক বিচার সরকার অবশ্যই করবে।
গাইবান্ধায় এসে দুপুর পৌনে ১টায় স্থানীয় সার্কিট হাউজে নির্বাচন উত্তর ও নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্থদের অবস্থা জানতে এবং তাদের সাথে মতবিনিময় এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক জনসভায় উপস্থিত হন শনিবার বিকেল ৩টায়। জেলা আ’লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ শামস-উল আলম হিরুর সভাপতিত্বে শহরের শাহ আব্দুল হামিদ স্টেডিয়ামে আয়োজিত স্মরণকালের এই বিশাল জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তাদের দোসর হলো স্বাধীনতা বিরোধী জঙ্গী সংগঠন জামায়াত-শিবির। একাত্তরে যারা গণহত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়েছিল তারাই হয়েছে বিএনপির দোসর। যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য বিএনপি নেত্রী আন্দোলনের নামে তাই নির্বিচারে মানুষ খুন করেছেন। তিনি বলেন, আসলে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না। যখনই দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে, তখন থেকেই খালেদা জিয়া তার দোসরদের নিয়ে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তবে বিএনপি নেত্রীর সাধ্য নেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্থ করার। এই বিচার শুরু হয়েছে, চলবে এবং রায়ও অবশ্যই কার্যকর হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি এলেই সহিংসতা হয়, চাল-ডাল, সারসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ে। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মানুষের কল্যাণ হয়। কেননা আ’লীগ মানেই জনগণের সেবক। সেই সেবা দিতেই পুন:রায় নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসেছে। ১৯৯১ সালে গাইবান্ধায় সারের দাবিতে কৃষকরা যখন আন্দোলন করছিল তখন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জে গুলি করে কৃষক হত্যার কথা মানুষ ভুলে যায়নি। অন্যদিকে আ’লীগ সরকারের আমলে সংকট তো দুরের কথা কৃষকের দোড় গোড়ায় সার পৌছে গেছে। ফলে কৃষি পণ্যের বাম্পার ফলন হয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলনের নামে সহিংসতা চালিয়ে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ ও অন্য এলাকায় ৩ জন পুলিশসহ ১০ জন মানুষকে হত্যা করেছে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসী চক্র। নির্বাচন ঠেকানোর নামে এই জেলাতেই ১শ ৫৭টি স্কুল তারা পুড়িয়ে দিয়েছে, আক্রমন করে আহত করেছে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের। তিনি প্রশ্ন করেন, স্কুলের উপর খালেদা জিয়ার উপর এতো রাগ কেন? কারণ তিনি এসএসসি পরীক্ষায় শুধু উর্দু এবং অংক ছাড়া আর সব বিষয়ে ফেল করেছিলেন। অংকে পাশ করার জন্যই ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি দুর্নীতির টাকা গোনাটা ভাল বুঝেছিলেন। তিনি এদেশের স্বাধীনতাকে বিশ্বাস করেন না, তাই মদদ দেন যুদ্ধাপরাধীদের। কারণ ‘ওনার দেলে আছে পেয়ারে পাকিস্থান’। তাঁর এতই যদি পাকিস্থান প্রীতি তাহলে তিনি সেই পেয়ারে পাকিস্থানে চলে গেলেই তো পারেন। কেন আর বাংলাদেশের মানুষকে মিছে মিছি কষ্ট দিচ্ছেন। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি। তাই এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে নিয়ে আর কিছুতেই ছিনিমিনি খেলতে দেব না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ কারও কাছে ভিক্ষা চাইবে না। কারও কাছে মাথা নত করবে না। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনেছি। এ দেশকে কারও কাছে মাথা নত করতে দেব না। তিনি বলেন, বিএনপি একজন মিলিটারি স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের হাত ধরে ক্ষমতায় এসেছিল। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু করি। খালেদা জিয়া ওই বিচার বন্ধের চক্রান্ত করেছিলেন, কিন্তু পারেননি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করার বহু চেষ্টা করেছিলাম। আমি নিজে তাঁকে ফোন করেছিলাম। ফোনে তাঁর কাছ থেকে অনেক কথাই শুনতে হয়েছে। তারপর তিনি তার দোসর জামায়াত-শিবিরের সহায়তায় সারাদেশে সহিংসতা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ভোটকে বন্ধ করার জন্য চেষ্টা চালান। কিন্তু জনগণ তা মানেনি। সব বাধা বিঘœ উপেক্ষা করে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সাংবিধানিক পন্থায় গঠিত হয়েছে সরকার। নানা প্রতিকুলতা সত্তে¡ও তিনি গাইবান্ধা জেলার সবকটি আসনে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করার জন্য তিনি গাইবান্ধাবাসিকে ধন্যবাদ জানান।
শেখ হাসিনা গাইবান্ধায় নদী ভাঙন প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, যমুনা নদে বালাসি-বাহাদুরাবাদ ঘাটের মধ্যে পুনরায় রেলওয়ে ফেরী চালু করা, সম্ভাব্যতা যাচাই করে বালাসি-বাহাদুরাবাদ ঘাটের মধ্যে একটি নতুন রেল সেতু নির্মাণ করার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, এ প্রতিটি গৃহহারা ভুমিহীন মানুষকে ঘর তৈরী করে দেয়ার প্রতিশ্রতি দিয়ে বলেন, এ জেলায় কেউ আর দরিদ্র থাকবে না।
জনসভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আযম, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা তারেক আজিজ,স্বরাষ্ট প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক মন্ত্রী এমপি ফার“ক খান, সাবেক মন্ত্রী এমপি ড. আব্দুর রাজ্জাক, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, গাইবান্ধার সাঘাটা-ফুলছড়ির এমপি অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া, গাইবান্ধা সদরের এমপি মাহাবুব আরা বেগম গিনি, পলাশবাড়ি-সাদুল্যাপুরের এমপি ডা: ইউনুস আলী সরকার, গোবিন্দগঞ্জের এমপি অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ, সুন্দরগঞ্জের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন, সাবেক এমপি মনোয়ার হোসেন চৌধুরী, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন, এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক, ফরহাদ আব্দুল্যাহ হারুন বাবলু, যুগ্ম সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্ডল, রণজিৎ বকসী সুর্য, শাহ সারোয়ার কবির, অ্যাড. শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবির মিলন, রেজাউল করিম রেজা, সাইফুল আলম সাকা, দীপক কুমার পাল, ছাত্রলীগ নেতা তাহমিদুর রহমান সিজু, ইউসুফ আলী জোয়ারদার প্রমুখ।
সুদীর্ঘ ৯ বছর পর গাইবান্ধায় এসেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার আগমনে উদ্দীপনায় উজ্জীবিত নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। তাকে এক নজর দেখতে এবং তার কথা শুনতে সকাল সাড়ে ১১টা থেকেই বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে খন্ড খন্ড মিছিল করে এবং শ্লোগান দিয়ে মানুষ গাইবান্ধার বিশাল এই স্টেডিয়াম মাঠে সমবেত হতে থাকে। জেলার ৭টি উপজেলা থেকেই বিপুল সংখ্যক মানুষ এই জনসভায় যোগ দিলে গোটা স্টেডিয়াম মাঠ ও মাঠের ৩টি গ্যালারী কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে জনসভা স্থলটি রীতিমত জনসমুদ্রে পরিণত হয়। মাঠে জায়গা না পেয়ে স্টেডিয়ামের পার্শ্ববর্তী রেললাইন এবং রাস্তায় দাঁড়িয়ে ও পার্শ্ববর্তী দোকানপাটে বসে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনেছেন আগ্রহী মানুষ। স্টেডিয়াম মাঠে জনসভাস্থলে আসার সময় সার্কিট হাউজ থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে বিপুল সংখ্যক নারী-পুরুষ হাত নেড়ে এবং জাতীয় পতাকা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানান।
এদিকে শেখ হাসিনার আগমন উপলক্ষে তোরণ, ব্যানার ও ফেষ্টুনে ছেয়ে যায় গাইবান্ধা শহরে তাঁর যাতায়াতের সড়কগুলো। স্টেডিয়ামে চারটি বিশাল বেলুন উড়ানো হয়। যাতে লেখা ছিল- গাইবান্ধায় প্রধানমন্ত্রীর আগমনের স্বাগত বার্তা এবং গাইবান্ধাবাসির প্রাণের দাবি ব্রহ্মপুত্র নদে বালাসীঘাট-বাহাদুরাবাদ বহুমুখী সেতু নির্মাণ, জেলায় অর্থনীতিক অঞ্চল গড়ে তোলা, গ্যাস সরবরাহ, বিজ্ঞান ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, স্থায়ীভাবে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা-তিস্তার ভাঙন প্রতিরোধ, সার কারখানা নির্মাণ, পলাশবাড়ি-সাদুল্যাপুর অঞ্চলে কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার দাবি।