জি নিউজ বিডি ডট নেট ডেস্ক:- ফরেনসিক ডাক্তার মিশায়েল সোকস যখন ঘটনাস্থলে আসেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ ইন্টেনসিভ কেয়ারে বড় বড় যন্ত্রপাতির মাঝখানে ছোট্ট এক অচেতন দেহ৷ চিকিৎসকের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার, আর কখনও হয়ত জ্ঞান ফিরবে না বাচ্চাটির৷ প্রায়ই বলা হয় শিশুটি সোফা থেকে পড়ে গিয়েছে৷ কিন্তু এটা হতে পারে না, একথা বলা হলে তখন আর একটি ব্যাখ্যা শুনতে হয়: বাচ্চাটি শেল্ফ বেয়ে উঠেছিল, তারপর ওপর থেকে পড়ে যায়৷”ডা. মিশায়েল সোকসের কাছে এই ধরনের ব্যাখ্যা পরিচিত৷ তিনি বলেন, ‘‘২০ বছর আগে তরুণ সহকারী ডাক্তার হিসাবে ফরেনসিক বিভাগে যখন কাজ শুরু করি, তখন মনে হতো এ সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা৷ কিন্তু তারপর মাঝে মাঝেই একই ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে৷”বহু শিশুর ময়না তদন্ত করেছেন-আজ ডা. মিশায়েল সোকস বার্লিনের ইউনিভার্সিটি ক্লিনিকের ফরেনসিক ইন্সটিটিউটের পরিচালক৷ কর্মজীবনে ৮০টি শিশুর পোস্ট মর্টেম বা ময়না তদন্ত করেছেন তিনি৷ এইসব শিশু শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে৷ অনেক শিশু আবার নির্যাতনের ফলে প্রতিবন্ধীও হয়ে যায়৷এক সময় সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায় ডা. সোকসের৷ বিষয়টিকে জনসমক্ষে তুলে ধরতে চান তিনি৷ আর তাই সহকর্মী সাসকিয়া গুডাটের সঙ্গে এই সব অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লেখেন৷ শিরোনামটাও অর্থবোধক, ‘‘জার্মানি তার শিশুদের নির্যাতন করে”৷ অপরাধীরা প্রায় ক্ষেত্রেই নিকট আত্মীয়-অপরাধ বিষয়ক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জার্মানিতে সপ্তাহে তিনটি শিশু শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যায়৷ অপরাধীরা নিকট আত্মীয়: মা-বাবা কিংবা তাঁদের নতুন সঙ্গী৷ ২০১২ সালে ৩৪৫০টি শিশু অত্যাচারের শিকার হয়৷ তবে পুলিশ বিভাগের মতে পরিসংখ্যানের বাইরে থাকা সংখ্যাটা আরো বেশি৷ডা. মিশায়েল সোকস ও সাসকিয়া গুডাট তাঁদের বইতে শিশুরক্ষা সমিতির সূত্র ধরে নির্যাতিত বাচ্চার সংখ্যা প্রতিবছর ২০০,০০০-এর মতো হবে বলে উল্লেখ করেন৷মুন্সটার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইওয়াখিম মার্শালের মতে সংখ্যাটা উঁচু করে ধরা হয়েছে৷ তিনি মনে করেন, বিপদাপন্ন যে সব বাচ্চাকে পরিবার থেকে বের করে আনা হয়, তা থেকে সংখ্যাটা অনুমান করা হয়৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘২০১২ সালে বিপজ্জনক পরিস্থিতির কারণে ৩০,২০০ শিশুকে পরিবার থেকে বের করে আনা হয়েছে৷”মা-বাবারা সন্তাদের কঠোর সাজা দেন-পুলিশের এক সমীক্ষার ফলাফল থেকে জানা যায়, ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মা-বাবা প্রায়ই সন্তাদের কঠোর সাজা দেন৷২০০০ সালের নভেম্বর মাস থেকে জার্মানিতে শিশু-অধিকার আইনত সুরক্ষিত৷ তাদের শারীরিক, মানসিক ও অবমাননাকর কোনো শাস্তি দেওয়া যাবে না৷ কিন্তু প্রায়ই পুলিশ ও যুব কল্যাণ দপ্তরের কর্মীরা আসার আগেই সহিংসতা চরমে ওঠে পরিবারে৷সংশ্লিষ্ট দপ্তর হস্তক্ষেপ করলেও জার্মানিতে বাচ্চাদের অধিকার সবসময় নিশ্চিত করা যায় না, বলেন এই ফরেনসিক চিকিৎসক৷ গণমাধ্যমেও প্রায়শ নির্যাতিত ও নিহত শিশুদের কথা উঠে আসে৷ এমনকি অনেক দিন ধরে পারিবারিক লাঞ্ছনার কথা যুব ও শিশু কল্যাণ দপ্তরকে জানানো সত্ত্বেও৷ কিছুদিন আগে ছোট্ট ইয়াগমুরের ঘটনা মানুষকে স্তম্ভিত করেছে৷ তিন বছরের মেয়েটি লিভারে আঘাত পেয়ে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে মারা যায়৷ তদন্তে জানা যায় নিজের বাবার হাতেই গুরুতর আঘাতের সম্মুখীন হয়েছিল সে৷ এর আগেও বাচ্চাটিকে অত্যাচার করা হয়েছে বলে মা-বাবাকে সন্দেহ করা হয়৷ কিছুদিনের জন্য এক পালক মায়ের কাছে রাখাও হয় তাকে৷ কিন্তু তারপর আবার নিজের মা-বাবার কাছে হস্তান্তর করা হয় শিশুটিকে৷মা-বাবা হতে হলে ‘লাইসেন্স’–শিশু নির্যাতনের বিষয়টি নিয়ে রাজনীতিবিদরাও এখন চিন্তাভাবনা করছেন৷ বার্লিন সিডিইউ-এর জেনেরাল সেক্রেটারি কাই ভেগনার হবু মা-বাবার জন্য ‘লাইসেন্স’-এর ব্যবস্থা করার কথা বলছেন৷ তাঁদের জন্য সন্তান লালন পালনের বিশেষ কোর্স প্রবর্তণের প্রস্তাব দিয়েছেন ৷ খবর ডি ডাব্লিউ এর, ফরেনসিক চিকিৎসক সোকোস মনে করেন, এক্ষেত্রে আর্থিক প্রণোদনাও একটা বড় বিষয়৷ যে কারণে বিপদাপন্ন বাচ্চাদের যতদিন সম্ভব তাদের নিজেদের পরিবারে রাখা হয়৷যুব কল্যাণ দপ্তরগুলি সমস্যা জর্জরিত পরিবারকে দেখাশোনার জন্য কিছু প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়৷ আর এই সব প্রতিষ্ঠান ততদিনই অর্থ পেয়ে থাকে যতদিন বাচ্চারা তাদের নিজেদের পরিবারে থাকে৷ ‘‘অন্যকথায় বাচ্চাদের দুঃখ দুর্দশা থেকে অর্থ উপার্জন করা হয়”, বলেন ডা. সোকস৷ তাঃ-১৪ ফেব্রুয়ারি২০১৪।