সাভার প্রতিনিধি , জি নিউজ ঃ সাভারে বিধ্বস্ত রানা প্লাজার বাইরে বৃহস্পতিবার নিখোঁজ প্রিয়জনের ছবি নিয়ে স্বজনদের দীর্ঘ প্রতীক্ষা – নিদ্রাহীন ক্লান্ত চোখে হাজারো মানুষ চেয়ে আছেন সাভারের রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের দিকে।
দীর্ঘ প্রতীক্ষা, কখন দেখা মিলবে নিখোঁজ প্রিয়জনের। উদ্ধারকর্মীরা কি তার নিথর দেহ টেনে বের করে আনবেন? নাকি ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর থেঁতলে যাওয়া দেহে নিভু নিভু প্রাণ নিয়ে ফিরে আসবে স্বজনদের মাঝে?
এমনি হাজারো উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় প্রহর গোনা স্বজনদের সঙ্গে জেগে আছে সাভারের লাখো মানুষ। উৎকণ্ঠিত গোটা দেশ। সব মিলিয়ে বেদনার বিষাদসিন্ধুতে পরিণত হওয়া এক জনপদ।
রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধারকর্মীরা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত একে একে ২৫৮ জনের মৃতদেহ বের করে এনেছেন। গুরুতর আহতাবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে আরো সহস্রাধিক নারী-পুরুষকে। এদের মধ্যেও বেশ কয়েকজন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। আহত অন্তত চারজনের হাত অথবা পা কেটে ফেলতে হয়েছে। এদিকে, মৃত্যুপুরীতে আরো কতজন আটকা পড়ে আছেন, তা কে জানে
আরো সহস্রাধিক নারী-পুরুষ ভেতরে আটকা পড়ে আছেন। তবে কেউ কেউ বলছেন, এদের সংখ্যা
হাজারেরও বেশি। তবে সংখ্যা যা-ই হোক, এদের মধ্যে কতজনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা যাবে- এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সবাই।
উদ্ধারকর্মীদের ধারণা, গরম এবং অক্সিজেনের অভাবে আটকেপড়াদের অনেকেই ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। এছাড়া ধসে পড়া ভবনের দেয়াল এবং ইট-পাথরের ছাদের কংক্রিটের বিশাল চাঁইয়ের নিচে চাপা পড়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ তাৎক্ষণিক মারা গেছেন।
তবে তাদের অবস্থান ভবনের মাঝামাঝি কক্ষে হওয়ায় উদ্ধারকর্মীরা এখনো ওইসব লাশ বের করে আনতে পারেননি। উদ্ধারকাজের নেতৃত্বে থাকা সেনা কর্মকর্তারা বলছেন, জীবিতদের দ্রুত বের করে আনতে তারা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু ৯ তলা ভবনের প্রতিটি ফ্লোরের পিলার এবং দেয়াল ভেঙে ছাদ যেভাবে স্তরে স্তরে গুঁড়িয়ে পড়েছে, তাতে উদ্ধারকাজ শেষ করতে আরো অন্তত ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা লাগার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, ৫-৬ মিনিটের মধ্যে গোটা ভবনটি মাটিতে গুঁড়িয়ে পড়ে। এ সময় প্রথম ও দ্বিতীয় তলা থেকে ২০-২৫ জন দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারলেও বাকিরা ভেতরে আটকা পড়েন। পরে আরো এক থেকে দেড়শ’ মানুষ ভবনের বিভিন্ন ভাঙা অংশ এবং খোলা জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে বাইরে বের হতে সক্ষম হন। মৃত্যুপুরী থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে আসা ব্যক্তিরা জানান, ভবনের ভেতরে অনেকেই বেঁচে আছেন। কিন্তু কারো হাত, কারো পা আবার কারো মাথা ছাড়া পুরো শরীর ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছে। অনেকেই আবার অন্ধকারে বাইরে বের হওয়ার পথ হারিয়ে ফেলেছেন।
ভবনের চতুর্থ তলার গার্মেন্ট শ্রমিক জাহানারা বেগম জি নিউজ বিডি ডট নেটের সাংবাদিক কে জানান, কাজ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরই বিদ্যুৎ চলে যায়। এর ৫-৭ মিনিট পরই জেনারেটর চালু করা হয়। এর পরপরই বিকট শব্দে গোটা ভবনটি কেঁপে ওঠে। জেনারেটর বিস্ফোরিত হয়েছে ভেবে ফ্লোরের শ্রমিকরা আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করেন। কিন্তু গেটের দিকে যেতে না যেতেই চারদিকের দেয়াল প্রায় একসঙ্গে ধসে পড়ে।
জাহানারা আরো জানান, অন্ধের মতো সামনের দিকে ছুটে গিয়ে শক্ত কিছুতে মাথা ঠুকে যায়। এরপর আর কিছু মনে নেই তার। কে বা কারা তাকে কিভাবে উদ্ধার করেছে, তাও জানেন না তিনি।
এদিকে, ধ্বংসস্তূপের ভেতরে অনেকেই এখনো বেঁচে আছেন বলে জানিয়েছেন সেখানে আটকেপড়াদের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা লাশগুলো সারিবদ্ধভাবে সাভার অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ এবং এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে। হাসপাতালে রাখা মরদেহগুলোর নাম-পরিচয় দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। ঢাকা রেঞ্জের অ্যাডিশনাল ডিআইজি মিজানুর রহমান জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৬৯টি মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বেশকিছু লাশের পরিচয় না মেলায় তা হিমাগারে রাখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের মরচ্যুয়ারিতে রাখা হয়েছে। হাসপাতাল ও বিদ্যালয়ে দেখা গেছে, উৎকণ্ঠিত স্বজনরা আপনজনের মরদেহ নিতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। লাশের গন্ধে দম আটকে আসছে। কিন্তু এর মধ্যেই পরম মমতায় ব্যাগে মোড়ানো এক একটি মৃতদেহ ছুঁয়ে দেখছেন স্বজনরা, খোঁজার চেষ্টা করেছেন প্রিয়জনদের। যারা পেয়েছেন, তারা কান্না নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। কিন্তু যারা পাননি, তাদের আহাজারি এখনো শেষ হয়নি। প্রিয়জনের লাশ খুঁজতে এসে কেউ কাঁদছেন বুক চাপড়ে, কেউবা আবার নীরবেই ঝরাচ্ছেন চোখের জল। আর সে জল নিয়েই দিগি¦দিক স্বজনের খোঁজে ছুটে বেড়াচ্ছে হাজারো চোখ, ছুটছেন এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে।