পুলিশের সহায়তায় সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবীদের উপর হামলা চালিয়েছে যুবলীগ ও ছত্রলীগের সশস্র ক্যাডাররা। রোববার ‘মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি’ উপলক্ষে আইনজীবীরা তাদের বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান গেটে অবস্থান করতে থাকলে বেলা ৩টা ২০ মিনিটে এ হামলা চালায় সরকারসমর্থক সংগঠনগুলোর ক্যাডাররা। এ সময় তাদের হাতে লাঠি, লগি, বৈঠা, কাচের বোতল ও ইট-পাটকেল ছিল। পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের হামলায় মারাত্মক আহত হয়েছেন ১০/১২ জন আইনজীবী। হামলার সময় এক নারী আইনজীবীকে পিটিয়ে বিবস্ত্র করা হয়। এছাড়া ঘটনাস্থল ও বাড়ি ফেরার পথে মোট ১৩ জন আইনজীবীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ঘটনাকে নজিরবিহীন বললেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি।
‘মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি’ উপলক্ষে সকাল ১০টা থেকেই সুপ্রিম কোর্টে জড়ো হতে থাকেন ১৮ দল সমর্থক আইনজীবীরা। তবে কর্মসূচি উপলক্ষে আগের দিন রাত থেকেই সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনে অবস্থান করছিলেন ৩০/৩৫ জন আইনজীবী। তারা সকাল থেকেই সেখানে প্রস্তুত ছিলেন। সকাল ১১টার দিকে পাঁচ শতাধিক আইনজীবী বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে মিছিলসহ নয়া পল্টনের উদ্দেশে রওয়ানা হন। তারা সুপ্রিম কোর্টের মেইন গেটে এলে পুলিশ গেট তালাবদ্ধ করে দেয়। পরে তারা সেখানেই অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে থাকেন। পুলিশ তাদের অবস্থানের উপর জলকামান নিক্ষেপ করলে প্রাথমিকভাবে আইনজীবীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। পরে তারা আবার সঙ্ঘটিত হয়ে সুপ্রিম কোর্টের গেটে অবস্থান নিয়ে সরকারবিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন। সকালে জলকামানের পাশাপাশি পুলিশ দুটি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে আবু জাফর মানিক ও নজরুল ইসলাম পাপ্পু নামে দুজন আইনজীবী মারাত্মক আহত হন। এভাবেই বিরতি দিয়ে দিয়ে চলতে থাকে আইনজীবীদের কর্মসূচি। সকালে আন্দোলনের সময় পুলিশের কড়া নিরপত্তায় সরকার সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনের মিছিল সুপ্রিম কোর্টের পাশ দিয়ে যায়। তারা এ সময় বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্য ও স্লোগান দেয়।
তবে পরিস্থতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায় বেলা ৩টা ২০ মিনিটের দিকে। এ সময় হঠাৎ সশস্ত্র যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা সুপ্রিম কোর্টের গেটে অবস্থান নেয়। আইনজীবীদের বাইরে যাওয়ার সুযোগ না দিতে সারা দিন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান গেট বন্ধ থাকলেও এ সময় পুলিশ যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডারদের তালা খুলে দিয়ে ভেতরে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। গেট খুলে দেয়ার সাথে সাথে বহিরাগত ক্যাডাররা আইনজীবীদের লক্ষ করে ইট, পাটকেল ও কাচের বোতল নিক্ষেপ করে ধাওয়া করতে থাকে। প্রায় পাঁচশত সশস্ত্র ক্যাডার একসাথে এ হামলা চালায়। এতে ভীত আইনজীবী ও সাংবাদিকরা দিকবিদিক ছুটতে থাকেন। আইনজীবীরা শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনে গিয়ে আশ্রয় নেন। বার ভবনের চারদিকে কলাপসিবল গেটে তালা দিয়ে কোনোরকমে আত্মরক্ষা করেন। সেখানে গিয়েও তারা নিরাপদে ছিলেন না। ক্যাডাররা বার ভবনের চারদিকে কর্ডন করে ফেলে। তারা এ সময় আইনজীবীদের তাদের সাথে লড়াইয়ের জন্য নিচে নামার আহ্বান জানায়। ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ঘণ্টা খানেক সেখানে তাণ্ডব চালায়। ঘণ্টাব্যাপী তাণ্ডব চালালেও কোনো পুলিশ বাহিনীর সদস্য তখন এগিয়ে আসেননি।
ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ধাওয়ার মুখে পড়ে দৌড়াতে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন দুই মহিলা আইনজীবী। তাদের দুজনকেই বেদম প্রহার করে ক্যাডাররা। এর মধ্যে অ্যাডভোকেট সিমকিকে পিটিয়ে বিবস্ত্র করে ফেলা হয়। ক্যাডারদের হামলায় মারাত্মক আহত হন রেহানা পারভীনসহ ১০/১২ জন আইনজীবী আহত হন। আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
বার ভবনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করার পাশাপাশি যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা আইনজীবীদের তিনটি মটরসাইকেল জ্বালিয়ে দেয়। দীর্ঘ প্রায় এক ঘণ্টা ধরে সরকার-সমর্থক ক্যাডাররা বার ভবন এলাকায় ভাঙচুর চালায় এবং বার ভবনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। তারা বার ভবন এলাকায় আইনজীবীদের খোঁজাখুঁজি এবং কয়েকজনকে মারধার করে। বার ভবনের ছাদ থেকে কয়েকজন আইনজীবীও এর জবাবে তাদের উপর বোতল ও ইটের টুকরা নিক্ষেপ করেন।
বেলা সোয়া ৪টার দিকে রমনা জোনের ডিসি মারুফ হোসেনের নেতৃত্বে কয়েক শত পুলিশ ও র্যাব বার ভবন এলাকায় অবস্থান নেয় এবং তারা সেখান থেকে বহিরাগত ক্যাডাররদের সরিয়ে দেয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত বার ভবন ঘেরাও করে রাখে পুলিশ সদস্যরা। মাগরিব আযানের পর বার ভবন থেকে নিজ নিজ বাসায় ফিরে যান সেখানে আশ্রয় নেয়া বেশির ভাগ আইনজীবী।
সারা দিনের আন্দোলন কর্মসূচি পালনকালে মোট ১৩ জন আইনজীবীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের সহসম্পাদক এ বি এম রফিকুল হক তালুকদার রাজা। এর মধ্যে সকালে প্রেস কাবে প্রবেশের সময় আটক করা হয় অ্যাডভোকেট ড. আরিফা জেসমিন নাহিনকে। বাকিদের কর্মসূচি শেষে বাড়ি ফেরার সময় বিভিন্ন প্রবেশ পথ থেকে গ্রেফতার করা হয়। তবে তাদের কারো নাম পাওয়া যায়নি।
বের হওয়ার সময় আইনজীবী নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। এটি নজিরবিহীন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে ঢুকে বহিরাগত আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আইনজীবীদের উপর হামলা চালিয়েছে। আমি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এটা চলতে পারে না। একইসাথে এর সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
সন্ধ্যায় এক ব্রিফিংয়ে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এ বি এম রফিকুল হক তালুকদার রাজা বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। আমি প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যে এর সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করতে অবশ্যই তিনি পদক্ষেপ নিবেন। আশা করি- এই ঘটনা ভবিষ্যতে হবে না। তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি থেকে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের অবিলম্বে মুক্তি দাবি করছি।
সকালে ১১টায় বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনে নেতৃত্বে পাঁচ শতাধিক আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট বার ভবন এলাকা থেকে বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে আরো অংশ নেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহবুবুর রহমান, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন, বারের সভাপতি এ জে মোহাম্মদ আলী, সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, অ্যাডভোকেট আবেদ রাজা, বারের সহসভাপতি এ বি এম ওয়ালিউর রহমান খান, অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান, আশরাফুজ্জামান, জামিল আখতার এলাহি, গাজী কামরুল ইসলাম সজল, মোহাম্মদ আলী, আবদুল্লাহ আল মাহবুব, মিজানুর রহমান মাসুম, শরীফ উদ্দিন আহমেদ, মির্জা আল মাহমুদ, জে আর খান রবিন, কাজী জয়নাল, আইয়ূব আলী আশরাফী, সিদ্দিক উল্লাহ মিয়া, জহিরুল ইসলাম সুমন প্রমুখ।
সুত্রঃঅনলাইন ডেস্ক