জি নিউজঃ- মুক্তিযুদ্ধকালে দখলদার পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী বদর বাহিনীর প্রধান আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বুধবার জনাকীর্ণ আদালতে এই আদেশ দেন। তার বিরুদ্ধে আনা মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের ৭টি অভিযোগের মধ্যে ৫টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেন, অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি ঘটনায় মুজাহিদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে। বিচার ঠেকাতে সারাদেশে জামায়াতে ইসলামীর ডাকা হরতালের মধ্যেই ‘আমৃত্যু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে’ দলটির সেক্রেটারি জেনারেলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেন বিচারক।মুজাহিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ৭টি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ১, ৩, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে- একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন অপহরণ এবং সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহির উদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল, আজাদকে হত্যা ও লাশগুম। ২ নম্বর অভিযোগ সত্য, তবে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলেনি এবং ও ৪ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। বুধবার বেলা ১১টার দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ জামায়াত নেতা মুজাহিদের মামলার রায় পড়া শুরু হয়। মুজাহিদের উপস্থিতিতে রায়ের ২০৯ পৃষ্ঠার মধ্যে ৩৭ পৃষ্ঠার রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ে শোনানো হয়। রায়ের প্রথম অংশ ও দ্বিতীয় অংশ পড়ে শোনান বিচারপতি মোঃ শাহিনুল ইসলাম এবং বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া। জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বড় ছেলে আলী আহমেদ তাশদীদ, মেজো ছেলে আলী আহমেদ তাহকীক, ছোট ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর উপস্থিত ছিলেন। সকাল ১০টা ৪১ মিনিটে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে কাঠকড়ায় তোলা হয়। সকাল পৌনে ১০টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাসে করে মুজাহিদকে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয়।
মঙ্গলবার সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বোধীন ৩ সদস্যের বেঞ্চ রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করেন। ২য় ট্রাইব্যুনালে জায়গা কম থাকায় বরাবরের মতোই ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে রায় ঘোষণা করা হচ্ছে। এর আগে ৫ জুন দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে গঠিত ৩ সদস্যের বেঞ্চে মামলার কার্যক্রম শেষ হয়।৪ জুন মামলার পক্ষে-বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান, যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আইনি পয়েন্ট পেশ শেষ করেন আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে মুজাহিদের পক্ষে ল’ পয়েন্ট উপস্থাপন শেষে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করে আসামিপক্ষের শুনানি শেষ করেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। এরপর রাষ্ট্রপক্ষে পাল্টা আইনি ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ আদালতে বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করেন। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ ব্যারিস্টার রাজ্জাকের আইনি পয়েন্ট পেশ শেষে প্রসিকিউশন তাদের পাল্টা ব্যাখ্যা করেন।
আইন সম্মতভাবে ল’ পয়েন্ট পেশ ও রাষ্ট্রপক্ষের ব্যাখ্যা দেয়ার পর মামলার কার্যক্রম শেষ করে রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ করে সিএভিতে রাখা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তুরিন আফরোজ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী আলবদর বাহিনী যেসব অপারেশন সংঘটিত করেছে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ছিলেন সেসব ঘটনার অঙিজেন। আনীত অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন দাবি করে মুজাহিদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- প্রার্থণা করেছেন প্রসিকিউশন। প্রসিকিউটর বলেন, মুজাহিদ সরাসরি কারো গায়ে হাত না তুললেও গণহত্যার দায় তারই। কারণ, মুজহিদ এমন একটা দলের দায়িত্বে ছিলেন যারা সংঘটিতভাবে একটি কমন পরিকল্পানার মাধ্যমে গণহত্যা চলিয়েছে। সে সময় কমান্ডার হিসেবে মুজাহিদ আলবদর বাহিনীর আদর্শ-উদ্দেশ্যের প্রতি অন্যদের উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং তাদের কর্মকা- সফল করতে বিভিন্ন জায়গায়ও সফর করেছেন। উল্লেখ্য, আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে গত বছর ২৬ আগস্ট শাহরিয়ার কবিরের সাক্ষ্য দেয়ার মধ্য দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এরপর এ মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) আব্দুর রাজ্জাকসহ প্রসিকিউশনের পক্ষে মোট ১৭ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। অপরদিকে মুজাহিদের পক্ষে একমাত্র সাফাই সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেয় তার ছোট ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর।গত বছর ২১ জুন মুজাহিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ৭টি ঘটনায় ৩৪টি অভিযোগে অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে- শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা, সাধারণ মানুষ হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও দেশত্যাগে বাধ্য করা ইত্যাদি। মুজাহিদ একক ও দলবদ্ধভাবে সরাসরি জড়িত থেকে ও নেতৃত্ব দিয়ে কিংবা সহযোগিতা ও নির্দেশ দানের মাধ্যমে এসব ঘটনা ঘটান বলে অভিযোগে বলা হয়েছে।ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার সংক্রান্ত একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেফতার করা হয়। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ : ৭১’এ মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, ধর্ষণসহ ৭টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এ অভিযোগগুলো হলো:- অভিযোগ-১ বলা হয়েছে, একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর চামেলীবাগ থেকে সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে অপহরণ করা হয়। মুজাহিদের পরিচালনাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন ৭-৮ জন যুবক তাকে ধরে মিনিবাসে তুলে নেয়। আজ পর্যন্ত তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
অভিযোগ ২-এ বলা হয়েছে, একাত্তরের মে মাসে একদিন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের নেতৃত্বে ফরিদপুর জেলার চর ভদ্রাসন থানার বিভিন্ন গ্রামের ৩০০-৩৫০ বাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা। পরে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে ৫০-৬০ জন হিন্দু নর-নারীকে হত্যা করা হয়। অভিযোগ ৩-এ বলা হয়েছে, একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের কোনো একদিন ফরিদপুর শহরের খাবাসপুর মসজিদের সামনে থেকে রাজাকাররা ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট এলাকার রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক করে। বেলা অনুমান ১১টার দিকে ফরিদপুর পুরনো সার্কিট হাউজে আসামি আলী আহসান মুজাহিদের সামনে পাকিস্তানি সেনা অফিসার মেজর আকরাম কোরাইশীর কাছে হাজির করা হয় বাবু নাথকে। তখন মুজাহিদ ওই মেজরের সঙ্গে কথা বলার পর বাবু নাথের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তার একটি দাঁত ভেঙে ফেলা হয়। নির্যাতনের পর মুজাহিদের ইশারায় তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বিহারি ক্যাম্পের উত্তর পাশে আবদুর রশিদের বাড়িতে নিয়ে রাজাকাররা আটকে রাখে। পরে রাতে রণজিৎ নাথ বাবু তার আটক ঘরের জানালার শিক বাঁকা করে ওই ঘর থেকে পালিয়ে জীবন বাঁচান। অভিযোগ ৪-এ বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৬ জুলাই সকালে ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা থেকে স্থানীয় রাজাকাররা মো. আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে আটক করে। এরপর পাখিকে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে রাখা হয়। আটক বন্দিদের মধ্যে আবু ইউসুফ পাখিকে দেখে মুজাহিদ পাকিস্তানি মেজরকে কিছু একটা বলার পরই তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। সেখানে ১ মাস ৩ দিন আটক রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ নির্যাতনে আবু ইউসুফ পাখির বুকের ও পিঠের হাড় ভেঙে যায়।অভিযোগ ৫-এ বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৩০শে আগস্ট রাত ৮টায় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের আরেক নেতা মতিউর রহমান নিজামীসহ ঢাকার নাখালপাড়ার পুরনো এমপি হোস্টেলের আর্মি ক্যাম্পে যান মুজাহিদ। সেখানে তারা আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহির উদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল ও আজাদকে দেখে তাদের গালাগাল করেন এবং পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে বলেন, প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। আসামি মুজাহিদ অন্যদের সহায়তায় আটকদের একজনকে ছাড়া অন্য নিরীহ-নিরস্ত্র বন্দিদের অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ গুমের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন। অভিযোগ ৬-এ বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৭ মার্চের পর ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে। পরে রাজাকার, আলবদর বাহিনীও সেখানে ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ছাত্রসংঘের শীর্ষ নেতা হওয়ার সুবাদে আর্মি ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। ছাত্রসংঘের ও আলবদর বাহিনীর সুপিরিয়র নেতা হিসেবে আর্মি ক্যাম্পে উপস্থিত ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন। এ ধরনের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুজাহিদ ১০ ডিসেম্বর থেকে পরিচালিত বুদ্ধিজীবী নিধনসহ হত্যা, নির্যাতন, বিতাড়নসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা সংঘটিত করেন। এদিকে ট্রাইব্যুনালে আসা সাংবাদিক ও দর্শনার্থীদেরও কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তল্লাশি চালিয়ে ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। আর রায়ের জন্য আসামি মুজাহিদকে নারায়ণগঞ্জ কারাগার থেকে মঙ্গলরাই ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। বুধবার সকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয় একটি মাইক্রোবাসে করে। আগের রায়ের দিনগুলোর মতো এদিনও সকাল থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে মিছিল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলসহ বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীদের ট্রাইব্যুনালের বাইরে জড়ো হতে দেখা যায়। তারা জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিতেও স্লোগান দেন।