জি নিউজ ঃ সাভারের ভবন ধসে উদ্ধারের তৃতীয় দিনে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এলেন শতাধিক পোষাক শ্রমিক। পুরো তিন দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের উদ্ধার করা হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ সদস্যদের সাথেএ উদ্ধার কাজে ক্লান্তিহীন ভাবে অংশ নিয়েছেন সাধারন মানুষ। সাভার বাজার বাস স্ট্যান্ডের কাছে রানা প্লাজা নামের নয় তলা ভবন ধসের ঘটনায় শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত ৩০৭ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এদিকে, বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার দুপুর সাড়ে ৩টা পর্যন্ত আরও ১০৭ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে দুপুরের দিকে একটি কক্ষ থেকে ১০ ও বিকেলে ২১ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তবে শুক্রবার বিকেলে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, তখন পর্যন্ত ২ হাজার ৩৭০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। শুক্রবার রাত ৯টার দিকে ১৬ জনকে উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে দুই জন মৃত। বাকিদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। আরেকটি কক্ষে আরো ২৩ জন উদ্ধারের অপেক্ষায় আছে বলে জানা গেছে। অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে লাশ হস্তান্তরে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা জানান, দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ২৮৭ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ৩৯টি লাশ রয়েছে। যাদের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগের লাশ ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। বাকিদের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে। সর্বশেষ খবর অনুয়ায়ী, ঢাকা মেডিকেল কলেজে (মর্গে) ১৫টি লাশ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ১১ নারী ও ৪ জন পুরুষের মৃতদেহ রয়েছে। ধসে যাওয়া ওই ভবনের নিচে আরও দুই হাজার মানুষ আটকা পড়ে আছেন বলে ধারণা করছেন উদ্ধারকর্মীরা । নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী, ওই ভবনের পোশাক কারখানার পাঁচটি ইউনিটে ৩১২২ জন শ্রমিক কাজ করতেন। এছাড়া নিচের দুই তলা ছিল মার্কেট। সেখানেও অনেক মানুষ ছিলেন। এদিকে স্থানীয় উদ্ধারকারীরা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার তৎপরতায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি ফায়ার সার্ভিসের লোকজন ধ্বংসস্তুপের ভেতরে ঢুকছেন না, দ্রুত ভেতরে ঢুকতে পারলে অনেক মানুষকে বাঁচানো যেত। গত বুধবার সন্ধ্যা নামার পর ঘটনাস্থলে অন্ধকার নেমে আসে। এতে উদ্ধার কাজে বিঘ্ন ঘটে। উদ্ধার কর্মীরা শুধু টর্চ লাইট জ্বালিয়ে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করেন। তবে শেষ পর্যন্ত রাত ১২টার দিকে সেখানে আলোর ব্যবস্থা করা হয়। বুধবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের কাছে ৭০ জন নিহত হওয়ার কথা জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক। এদিন মধ্যরাত পর্যন্ত ৯৮ জনের লাশ সনাক্ত করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। হস্তান্তরকৃত লাশের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকার চেক দেয়া হয়েছে। ঘটনাস্থলের পাশে অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে লাশ জড়ো করে সেখান থেকেই সনাক্ত করার পর স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে। ঘটনা ঘটার কিছুক্ষণ পরে ভবনের ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে উদ্ধার করে স্থানীয় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাদের নেয়া হয়, তাদের মধ্যে ৫৭ জনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। এছাড়া স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপেক্সে ৬, একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ১ এবং আরেকজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
কংক্রিটে মিশে আছে পিষ্ট হওয়া শত শত লাশ ধসে পড়া ভবনের দেওয়াল ও ছাদের কংক্রিটের সঙ্গে এখনো চাপা পড়া মানুষের মৃতদেহ আছে । কংক্রিটের খাঁজে খাঁজে পিষে থাকা লাশগুলো ইতিমধ্যেই পচতে শুরু করেছে। ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। তবে ভবনের বিভিন্ন তলার দেওয়াল ও কংক্রিটের ভাঙ্গা অংশ না সরানো পর্যন্ত বাকি লাশগুলো উদ্ধার সম্ভব হবেনা বলে জানালেন উদ্ধারকর্মীরা। তবে এখনই উদ্ধার কাজে ক্রেন বা ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ঝুঁকি নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সিদ্দিকুল আলম শিকদার জি নিউজ বিডি ডট নেটকে জানিয়েছেন, এখনও ওপরের তলাগুলোতে মানুষ বেঁচে আছে। তাছাড়া কয়েকশ’ স্বেচ্ছাসেবক বিভিন্ন তলায় বিরতিহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এ কারণেই ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ঝুঁকি এই মুহূর্তে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ধসে যাওয়া ভবনের চার ও পাঁচ তলায় গিয়ে দেখা গেছে, কংক্রিট, লোহা, গার্মেন্টসের কাপড়, সুতোর টোটা, ফিতে ইত্যাদি লাশের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। তিনতলার ওপরের তলাগুলো ভেঙ্গে দেবে গেলেও নিচের তলাগুলোর অবস্থা কি তা বোঝা যাচ্ছে না। বিমগুলো ছড়িয়ে আছে বিচ্ছিন্নভাবে। স্বেচ্ছাসেবক ও উদ্ধারকারীরা কোথাও বাঁশ আবার কোথাও ইট দিয়ে ওই সব ভাঙ্গা কংক্রিটের পতন ঠেকাচ্ছেন। এর মধ্যেই কংক্রিট কাটা মেশিন দিয়ে ফ্লোর কেটে ভেতরে জীবিত মানুষের খোঁজ করছেন উদ্ধারকারী দল। তবে অধিকাংশ সময়েই বেরিয়ে আসছে হতভাগ্য গর্মেন্টস কর্মীদের লাশ। এছাড়া যাদের জীবিত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে তাদের উদ্ধার করাও কঠিন হয়ে পড়ছে।
উদ্ধারকারী জানান, বিভিন্ন রকম সুগন্ধি ছড়িয়েও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। অক্সিজেনের অভাব আর লাশের দুর্গন্ধে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এছাড়া ঘটনাস্থলে প্রচুর উদ্ধারকর্মী থাকলেও সমন্বয়হীনতার কারণে উদ্ধারকাজের গতি নেই বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকর্মীরা।
এদিকে সাভারে ধসে পড়া রানা প্লাজার আহতদের সাহায্যার্থে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রক্ত, অর্থ, খাবারসহ উদ্ধার অভিযানের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ দিয়ে তারা আহত ও উদ্ধার কর্মীদের সহযোগিতা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা পৃথকভাবে ও বিভিন্ন সংগঠন তাদের নিজ উদ্যোগে এই সহযোগিতা করছেন।
আল-আমিন/জি নিউজ