আমিনুল ইসলাম,বাড্ডা,ঢাকাঃঢাকাঃ নিকষ কালো অন্ধকারের মাঝে লেজার লাইটের ঝলকানি। হিন্দি ও ইংরেজি পপ গানের কান ফাটানো শব্দ।এর মধ্যে সিসা আর সিগারেটের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। আর নেশার ঘোরে চলছে বেসামাল তরুণ-তরুণীদের উন্মাতাল নাচ।
রাজধানীতে নিত্যদিনের ডিজে পার্টিতে এটা এক সাধারণ দৃশ্য।প্রতিরাতেই বেশ কিছু কমিউনিটি সেন্টার, সামাজিক ক্লাব ও পাঁচ তারকা হোটেলে চলে এ ধরনের পাটি। আর ডিজে পার্টির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এখানে আসা যুবক-যুবতীরা মেতে ওঠে জমজমাট সিসা, মদ ও ইয়াবা সেবনে।
এক মাস ধরে চালানো অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ডিজে পার্টির অন্দরমহলের সেসব অজানা কাহিনী।
‘ডিজে’ মানে ডিস্কো জকি। অর্থাৎ গানের তালে তালে নাচের উন্মাদনা তৈরির জন্য মাইক্রোফোনের মাধ্যমে যারা নানা ধরনের উত্তেজক শব্দ উচ্চারণ করে তারাই ডিস্কো জকি। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী রাজধানীতে ডিজে পার্টি আয়োজনের শীর্ষে রয়েছে তিনটি গ্রুপ। এরা ডিজে পার্টির নামে সিসা, অবৈধ মদ ও ইয়াবাসহ মাদক সেবনের নিয়মিত আড্ডা বসাচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, এই তিন গ্রুপের এক নম্বরে আছে জামিল, নাতাশা, টুম্পা ও ডিজে লেমন গ্রুপ।
ডিজে পার্টির অন্দরমহলের পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে রাত ১১টায় সেখানে হাজির অনুসন্ধান টিম। ১৫ তলা এ ভবনের ১২ তলায় ডিজে পার্টির আয়োজন চলছে। ভবনের নিচে প্রতিমন্ত্রীর গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা। ভবনের কিছুটা দূরে পুলিশের অবস্থান। টিকিট কেটে ডিজে পার্টিতে ঢোকেন দুই প্রতিবেদক।
ভেতরে তখন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ঘরের মাঝখানে খোলা জায়গায় হিন্দি গানের তালে তালে তরুণ-তরুণীদের উন্মাতাল নাচ। ঘরের বিভিন্ন কোনায় টেবিল-চেয়ার পাতা। সেখানে বসে অনেকেই রাংতার পাতায় সাজিয়ে নিচ্ছেন ইয়াবার গুঁড়ো। এরপর রাংতার নিচে ম্যাচের কাঠির আগুন দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ধোঁয়া। সেই ধোঁয়া বিশেষ একটি চোঙ্গার মাধ্যমে মুখ দিয়ে নয়, নাক দিয়ে টেনে নেয়া হচ্ছে। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে তাদের নেশাগ্রস্ত চেহারা লাল হয়ে উঠেছে।
এক কোণে সিসার আসর বসেছে। বড় বড় কয়েকটি সিসার পাত্র সাজিয়ে নল দিয়ে ধোঁয়া টানছেন কয়েকজন কিশোর-কিশোরী। ঘরের এক কোণে বড় একটি কাঠের তাকে সাজিয়ে রাখা নানা ব্র্যান্ডের বিদেশী মদ-বিয়ার। ৫/৬ জন বেয়ারা গ্লাসে গ্লাসে মদ ঢেলেও কুলিয়ে উঠতে পারছেন না।
ভেতরে এই যখন অবস্থা তখন হঠাৎ একজন ‘মাস্তান’ হাজির হলেন মদ বিক্রির কাউন্টারে। তিনি কোমর থেকে পিস্তল বের করে রাখলেন টেবিলের ওপর।এবার পুরো একটি মদের বোতল দিয়ে দিতে বললেন। এতে গণ্ডগোল বেধে গেল। হইচই থামাতে এগিয়ে এলেন পার্টির নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত বিশেষ টিম (বাউন্সার)। তারা অস্ত্রধারীকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু অস্ত্রধারী মোটেও দমলেন না। এবার তিনি আরও উদ্ধত হয়ে তার অস্ত্রটি উঁচু করে ধরে বললেন, ‘আমি ছাত্রলীগের নেতা। এখানে পার্টি চালাতে হলে আমাকে মদ দিতে হবে। একপর্যায়ে তিনি এক বোতল মদ ও ইয়াবাসহ সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে একটি টেবিল দখল করলেন।
ওদিকে ইয়াবা আর সিসার নেশায় উন্মত্ত আরেকজন মাঝবয়সী।
তিনি একজন তরুণীকে পাঁজাকোলা করে তুলে ধরেছেন। তরুণীটিকে তিনি বাইরে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু পার্টির আয়োজকরা বাইরে মেয়ে নিয়ে যেতে দিতে রাজি নন। এ নিয়ে কিছুক্ষণ ওই মাঝবয়সীর সঙ্গে পার্টির আয়োজকদের ধস্তাধস্তি হল।
এ অনুষ্ঠানে দেখা যায় ডিজে হিমু, বাপ্পি, আনার, মারুফ, সুমি, রাজন, প্রিয়া ও ডিজে আরিনকে। তারা নেচে চলেছেন বিভোর হয়ে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পার্টিতে অতিথিও বাড়তে থাকে। আয়োজকদের একজন জানালেন পার্টি চলবে ভোর ৪টা পর্যন্ত।
রাতভর পার্টি দিনভর ঘুম: এই ডিজে পার্টিতে কথা হল রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফারজানা খান নিঝুমের সঙ্গে। তিনি জানান, সপ্তাহের দু’একটা দিন বয়ফ্রেন্ডদের নিয়ে ডিজে পার্টিতে তিনি স্ট্রেস (অবসাদ) কাটাতে আসেন। এতে অন্যদিনগুলোতে পড়ালেখার এনার্জি পান। তবে ডিজে পার্টি থেকে ফিরে পরদিন তিনি ইউনিভার্সিটিতে যেতে পারেন না। পরের দিনটা ঘুমিয়ে কাটান। নিঝুমের সঙ্গে পার্টিতে এসেছেন তার বয়ফ্রেন্ড মনজুর মোর্শেদ সেজান। তিনি বলেন, ঢাকায় আনন্দ করার মতো জায়গা নেই। তাই ডিজে পার্টি উন্মুক্ত করে দেয়া উচিত। পুলিশ ও র্যাবের ভয় নিয়ে পার্টিতে আসেন বলে পার্টি পুরোপুরি উপভোগ করতে পারেন না। সংক্ষিপ্ত কথার মাঝে মাঝে তিনি বুকভরে সিসার ধোঁয়া নিচ্ছিলেন। আর তার বান্ধবী নিঝুমের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।
নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশ: ডিজে পার্টির অনুষ্ঠানস্থলের কিছুটা দূরেই ৬ জন পুলিশ দায়িত্ব পালন করছেন। দায়িত্ব পালনরত পুলিশকে
জিজ্ঞেস করা হয়, এখানে অবৈধ মাদকের আড্ডা চললেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? জবাবে তিনি বলেন, যেখানে অনুষ্ঠান হচ্ছে সেটির মালিক এক প্রতিমন্ত্রীর ছেলে। তাই এখানে অভিযান চালানোর ক্ষমতা তাদের নেই। বরং তারা এসেছেন নিরাপত্তা দিতে।
বহুতল ওই ভবনের নিরাপত্তা প্রহরী শহিদুল জানান, ভবনের ১২ ও ১৩তম ফ্লোরের মালিক একজন প্রতিমন্ত্রীর ছেলে। তাই এখানে পুলিশ বা র্যাব কখনোই আসে না।ডিজে পার্টির আয়োজক জানান, ‘এ জায়গাটি নিরাপদ হওয়ার কারণে এখানে নিশ্চিন্তে তারা অনুষ্ঠান করতে পারেন। তাই টিকিট বিক্রিও জমজমাট।
গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গুলশান ও বনানী এলাকায় অনুষ্ঠিত ডিজে পার্টির জন্য কেউ পুলিশের অনুমতি চান না। তবে থার্টিফার্স্ট নাইটের (৩১ ডিসেম্বর রাতের) অনুষ্ঠান করার সময় পুলিশের কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন আসে। এসব আবেদনেও ডিজে পার্টি না লিখে ‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’-এর জন্য অনুমতি চাওয়া হয়।
জানতে চাইলে পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার লুৎফুল কবির বলেন, অনেক ডিজে পার্টিতে মাদক বেচাকেনার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। খবর পাওয়া মাত্র তারা অভিযান চালান। কোনো ছাড় দেয়া হয় না।
ওদিকে ডিজে পার্টি সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, যেখান থেকে মাসোয়ারা পেতে বিলম্ব হয় পুলিশ শুধু সেখানেই অভিযান চালায়। মূলত পুলিশকে ম্যানেজ করেই ডিজে পার্টি চলে।