আইএসআইএল এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার কুর্দি অধ্যুষিত এই জেলায় হামলা করেছে, কিন্তু সফল হয়নি। কারণ সেখানে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সশস্ত্র এবং তারা তাদের মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে।
তাকফিরি-ওয়াহাবি সন্ত্রাসী দল আইএসআইএল কয়েক মাস আগে ইরাকের মসুল শহর দখল করতে সক্ষম হয় একদল সরকারি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রের কারণে। সাদ্দামপন্থী এইসব কর্মকর্তাদের অনেককেই সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করেছে ইরাক সরকার।
খুব সহজেই মুসেল জয় করার সুবাদে আইএসআইএল সেখানে বিপুল সংখ্যক কামান, ট্যাংক, ভারী অস্ত্র এবং ব্যাংক ও তেল-ক্ষেত্রসহ বিপুল অর্থ সম্পদেরও অধিকারী হয়। এরপর বিদেশী মদদপুষ্ট এই সন্ত্রাসী দলটি গত বছরের ৬ ই অক্টোবর তুরস্ক-সংলগ্ন সিরিয়ার কুবানিতে অবরোধ আরোপ করে তিন দিক থেকে হামলা চালায়। তারা এ অঞ্চলের প্রতিরক্ষা ব্যূহে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয় এবং পূর্ব দিক থেকে এই জেলায় ঢুকে পড়ে। কিন্তু তারপরও কুবানির প্রতিরোধ-যোদ্ধারা রাস্তায়-রাস্তায়, অলিতে-গলিতে ও বাসভবনগুলো থেকে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। তারা ও বিশেষ করে, কুর্দি পিশমার্গা বাহিনী ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর বীরত্বপূর্ণ অভিযান চালিয়ে কুবানির বিপুল অঞ্চল মুক্ত করে। ২০১৫ সালের প্রথম দিকেও কুর্দি সেনারা কুবানির আরো কিছু অঞ্চল মুক্ত করতে সক্ষম হয়। ফলে কুবানি এখন বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের প্রতীক।
আইএসআইএল সিরিয়ার কুর্দি অধ্যুষিত কুবানিকেও তাদের কথিত খিলাফতের আওতাভুক্ত করতে চেয়েছিল। তুরস্ক-সংলগ্ন কুবানি দখল করতে পারলে সিরিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের পথগুলোও আইএসআইএল-এর জন্য খুলে যেতো। উল্লেখ্য কুবানির প্রতিরোধ লড়াইয়ে স্থানীয় কুর্দি নারীরাও বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের প্রায় ৪০ শতাংশই হচ্ছেন নারী।
কুবানির বীরাঙ্গনা কুর্দি নারীরা বিভিন্ন সংবাদ-মাধ্যমকে জানিয়েছেন, তারা প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে দৃঢ়-সংকল্প। আইএসআইএল-এর সন্ত্রাসীরা এ অঞ্চল দখল করতে পারলে গণহত্যা চালাবে ও মানবীয় বিপর্যয় ঘটাবে বলেও তারা শঙ্কিত। তারা জানেন কুবানিকে হাতছাড়া করার অর্থ হলো হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, যৌন-দাসত্ব এবং নারী ও কন্যাদের বিক্রি করে দেয়া। আর এ জন্যই তারা বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছেন এবং মূলত এই প্রতিরোধের কারণেই আইএসআইএল এখনও কুবানি দখল করতে সক্ষম হয়নি। নাসরিন এবাদি নামের এক কুর্দি বীর নারী যোদ্ধা বলেছেন,
‘আমি এ জন্যই অস্ত্র হাতে নিয়েছি যে, একদিন হয়তো নিজেকেই গুলি করতে হবে।’ ২০ বছর বয়সী নাসরিন এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। পরিবারের সঙ্গে এতোদিন সুখেই ছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রী এখন মনে করেন আইএসআইএল-এর সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের হাতে বন্দী হওয়ার চেয়ে যুদ্ধ করে মরে যাওয়াই উত্তম। তিনি বলেছেন:
‘ সবাই এটা জানে যে, আইএসআইএল আপনাদের যদি ধরতে পারে তাহলে কি ঘটবে। নারী হলে প্রথমে ধর্ষণের শিকার হবে ও পরে তার মাথা কেটে ফেলা হবে। ব্রিটিশ ও মার্কিন পণবন্দীদের ভিডিওতে এসবই দেখেছি। আমাদের সঙ্গেও ওরা একই কাজ করবে। আমি একটি কালাশিঙ্কোভ রাইফেল বহন করতে জানি। কিন্তু কখনও কোনো আইএসআইএল-সদস্যের মুখোমুখি হলে জানি না ঠিক কি করবো। হয়তো তাকে হত্যা করবো হয়তো বা নিজেকে।’
যেসব কুর্দি নারী কুবানিতে যুদ্ধ করছেন তাদের কারোই সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল না। তাদের কেউ কেউ ছিলেন চাকুরীজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী এবং কেউ কেউ ছিলেন গৃহবধু। কুবানির নারীরা যুদ্ধ করছে বলে তাদের সহযোদ্ধাসহ সব কুর্দি পুরুষই গর্ব অনুভব করছেন। ৫ হাজারেরও বেশি কুর্দি নারী আইএসআইএল-এর সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। এদের মধ্যে ৫০০ জন লড়াই করছেন একেবারে সন্মুখ রণাঙ্গনে।
সিরিয়ার কুর্দি গণ-বাহিনীর নারী কল্যাণ বিভাগের সদস্য না’রিন আফরিন বলেছেন:
‘কুর্দি নারীরা চাপিয়ে দেয়া এই যুদ্ধে ঘরে বসে নেই। কুর্দি নারীর দেশপ্রেম অন্য মুসলিম নারীর চেয়ে কম নয়। আমরা উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে লড়ছি না। আমরা লড়ছি মানবতা রক্ষার জন্য এবং কুর্দি, তুর্কি ও আরবদের অভিন্ন শত্রুকে মোকাবেলার জন্য। আমাদের কুর্দি পরিচয়ের চেয়েও বড় পরিচয় হলো আমরা সিরিয়। আমরা চাই সিরিয়া একটি মুক্ত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকুক।’ (সূত্র: দৈনিক আশশারকুল আওসাত)
কয়েকদিন আগে বার্তা সংস্থা এপি সাক্ষাতকার নিয়েছিল কুবানির এক বীর নারীর। আফশিন নামের এক সিরিয় কুর্দি নারী এক বছর আগেও ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। আজ তাকে ক্লাস ছেড়ে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। ২৮ বছর বয়স্ক এই বীর নারী বলছেন: ‘আইএসআইএল-এর সন্ত্রাসীরা সিরিয়ার দিকে এগিয়ে আসছে দেখে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেই। যুদ্ধ আমার অনেক বন্ধুকে কেড়ে নিয়েছে। তাই সিদ্ধান্ত নেই যে আমরাই যদি কুবানিকে রক্ষার জন্য এগিয়ে না আসি তাহলে কারা এই কাজ করবে?’
সিরিয়ার কুর্দি বীর নারীরা আইএসআইএল-এর জন্য বড় ধরনের আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। এটা বিশেষ করে, এ কারণে যে, এই ওয়াহাবি-তাকফিরিরা মনে করে, নারীদের হাতে নিহত হলে বেহেশত পাওয়া যায় না!
অন্যদিকে কুবানির বীর কুর্দি নারীরা মৃত্যুকে কোনো পরোয়া না করেই হাসিমুখে জীবন বাজি রেখে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। গত বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত ২৪ জন বীর কুর্দি নারী আইএসআইএল ও আন-নুসরার সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছে। এইসব সন্ত্রাসী দল তাদের হাতে বন্দি হওয়া কুর্দি নারীদের ওপর নৃশংসতা পাশবিক আচরণ করায় কুর্দি নারী যোদ্ধারা তাদের রাইফেলের সর্বশেষ গুলিও ব্যবহার করছেন তাকফিরি-ওয়াহাবিদের বিরুদ্ধে যাতে এইসব পশুদের হাতে কখনও বন্দী হতে না হয়।
১৯ বছর বয়স্ক সিরিয় কুর্দি বীরাঙ্গনা ‘যিলান আওজ আলেব’ কিছু দিন আগে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হওয়ার আগে সম্মানজনক মৃত্যুর পথ বেছে নেয়ার কথাই বলেছিলেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন: ‘আইএসআইএল এর সন্ত্রাসীরা যখন কোনো নারী যোদ্ধাকে দেখে তখন ভীরু কাপুরুষের মতো ভয়ে কাঁপে। ওরা নিজেদেরকে সাহসী বলে দাবি করে আসলেও আসলে আমাদের একজন নারী ওদের দশজন পুরুষের সমান শক্তি রাখে।’
কুবানির বীরাঙ্গনা নারীরা কঠোর প্রতিরোধ অব্যাহত রাখায় সম্প্রতি আইএসআইএল হুমকী দিয়ে বলেছে, কুবানির প্রত্যেক নারী যোদ্ধা যদি তাদের অস্ত্র ভূমিতে ফেলে না দেয় তাহলে তাদের বন্দি করা হবে এবং তাদের জোর করে বিয়ে করা হবে।
ডেইলি মেইল কুবানির নারী যোদ্ধাদের অন্যতম কমান্ডার নাহিদ আহমাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। নাহিদ বলেছেন, ওরা আমাদের ঘৃণা করা সত্ত্বেও জোর করে বিয়ে করার হুমকী দিচ্ছে। ওদের এই হুমকীর মোকাবেলায় আমাদের অন্য আইডিয়া রয়েছে। আর তা হলো বন্দি হওয়ার মুহূর্তে একটি গুলি রাখবো।খবর:রেডিও তেহরান, এভাবে কুবানির বীর নারী যোদ্ধারা যুদ্ধক্ষেত্রেই জাতির ভাগ্য নির্ধারণের জন্য লড়াই করছেন। আমরা আশা করছি, কুবানির নারীরা আইএসআইএল পাশবিকতার শিকার হবেন না।