রংপুর জেলা প্রতিনিধিঃ উজানের পানি প্রবাহ দিন দিন কমে আসায় তিসত্মা নদীর পানি কমে মরম্নভূমিতে পরিণত হচ্ছে। তিসত্মার বুক জুড়ে খরস্রোতা জলের স্রোত আর নেই। যুগ যুগ ধরে যে নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের মানববসতি ও সভ্যতা, ভাটিয়ালি আর ভাওয়াইয়া গান, সেই চির যৌবনা তিসত্মা ক্রমাগত ক্ষীণ হয়ে মরে যাচ্ছে। হিমালয়ের তুষারগলা পানি আর বৃষ্টি ধারায় তিসত্মার জল যতই বেড়ে উঠুক না কেন এখন তা মানুষের হাতে বন্দি। তিসত্মার বুক জুড়ে জেগে উঠেছে বিসত্মৃর্ণ চর। উজানে ভারত ব্যারেজ নির্মাণ করে তিসত্মার প্রাকৃতিক প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। একতরফা পানি প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে বাংলাদেশের ১১২ মাইল দীর্ঘ এই নদী শুকিয়ে এখন প্রায় মৃত।
হাতীবান্ধায় অবসি’ত তিসত্মা সেচ প্রকল্পের ৭০ কিলোমিটার উজানে ভারতের গজলডোবা ব্যারেজ কতৃপক্ষ তিসত্মার পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করায় বাংলাদেশ অংশে বোরো মৌসুমের শুরম্নতেই তিসত্মার বুকে বালু উড়ছে মরম্নভূমির মতো। এতে তিসত্মার নাব্যতা ফের হারিয়ে ধূ ধূ বালুচরে পরিণত হয়েছে। হঠাৎ করে তিসত্মায় ঢল নেমে যাওয়ায় পানি প্রবাহ এখন কমছে তো কমছেই। চলতি সেচ নিভর্র বোরো আবাদের প্রাক্কালে অমীমাংসিত তিসত্মার পানি বন্টন চুক্তি বাসত্মবায়িত না হলে, দেশের বৃহৎ তিসত্মা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ছয় লাখ হাজার হেক্টর জমির বোরো আবাদ হুমকির মুখে। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ লাখ মেট্রিকটন ধান।
আর্থিক মূল্য প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা এবং এ ঘাটতির অর্থ গুনতে হবে বাংলাদেশ সরকারকেই। চলতি মৌসুমের শুরম্নতেই তিসত্মা সেচ প্রকল্পের পানির অভাবে সেচ নির্ভর বোরো চাষাবাদ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হতে শুরম্ন করেছে। এই প্রকল্পের সেচ প্রবাহের প্রধান শাখা খালগুলো পানির জন্য হা-হা কার করছে মৌসুমের শুরম্নতেই। এ দৃশ্যে বৃহত্তর উত্তরাঞ্চলের বোরো চাষী হতাশ হয়ে পড়েছেন।
প্রকল্পের আওতাধীন রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার গান্নারপাড় এলাকার কৃষক মনোয়ার হোসেন, আবুল কালাম, চাঁন মিয়া, বাশার উদ্দিন, কামাল মিয়া বজলার রহমান ও মোশারফ হোসেনসহ অনেকেই জানান, বর্তমানে সার কীটনাশক, বীজ ও জ্বালানি তেলের মূল্য ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করায় এবং উৎপাদিত ফসল ঘরে তুলে বাজারজাত করে, বাজার মূল্যে ধসে পড়ায় আমরা কৃষিজীবীরা হিমসিম খেয়ে এনজিওসহ বিভিন্ন দাদন ব্যবসায়ীদের নিকট ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। তার উপর তিসত্মা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের পানি না পাওয়া গেলে জ্বালানি তেল পুড়িয়ে অথবা বিদ্যুৎ খরচ করে সেচ নির্ভর বোরো চাষ আমাদের জন্য র্দুসাধ্য হয়ে পড়বে। তাই বোরো চাষের শুরম্নতেই তিসত্মা নদীর পানি বন্টন চুক্তি বাসত্মবায়িত না হলে, বেশিরভাগ সেচ নির্ভর বোরো চাষাবাদ জমি পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে থাকবে। সেই সঙ্গে উত্তরাঞ্চলসহ দেশে পড়বে চরম খাদ্য সংকট।
তিসত্মা ব্যারেজ প্রকল্পের নির্বাহি প্রকৌশলী দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এক সময় তিসত্মা নদীর পানির প্রবল স্রোতে তিসত্মাপাড়ের হাজার হাজার হেক্টর জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যেত। তিসত্মায় ভয়াবহ ভাঙ্গন আর নির্মমতায় লাখ লাখ পরিবার নিঃশ্ব হয়ে ছিন্নমূল জীবন সংগ্রামে নামা ছাড়া আর কোন উপায় থাকত না। সেচ নিভর্র ফসল উৎপাদনের কথা ভেবে তৎকালীন সরকার বাংলাদেশ-ভারত সীমানেত্ম লালমনিরহাট ও নীলফামারী সীমা রেখায় বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিসত্মা ব্যারেজ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সে অনুযায়ী ১৯৬০ সালে হেইগজিন এন্ড এসোসিয়েশন এসিই লিমিটেডের সহযোগিতায় তিসত্মা ব্যারেজের সেচ প্রকল্পের প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রস’ত করা হয়। বিশেষ করে স্বাধীনতার পরর্বতী সময়ে দেশের চরম খাদ্য সংকট মোকাবেলায় সরকারের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় পাউবো ও প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ প্রকৌশলীদের নিয়ে ব্যারেজ সেচ প্রকল্প বাসত্মবায়নের সিদ্ধানত্ম গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটি বাসত্মবায়নে নিজস্ব প্রকৌশলীদের প্রযুক্তি ও কায়িক শ্রম নিয়ে ১৯৭৯ সালে তিসত্মা ব্যারেজ সেচ প্রকল্প নির্মাণে পরিকল্পনা ও ডিজাইন প্রণয়নে ভিত্তি স’াপন করা হয়। পরে ১৯৮৪ সালে এর নির্মাণ কাজ পুরোদমে শুরম্ন করা হলে প্রকল্পটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়। প্রথম পর্যায়ে ফেজ-১, দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, জয়পুরহাট এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ফেজ-২, ২০০৪ সালের ২১ জানুয়ারি একনেক সভায় ১১০০ কোটি ১৬ হাজার ৬৫৪ টাকা নীতিগতভাবে অনুমোদন ব্যয়ে বগুড়া-রাজশাহী বিভাগে তিসত্মা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের অনর্ত্মভূক্ত করা হয়।
প্রকল্পটির আওতায় সেচনিভর্র বোরো আবাদের মোট জমির পরিমান ছয় হাজার হেক্টর নির্ধারণ করা হয়। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩৪ লাখ ৫৪ হাজার ৪৫০ মেট্রিকটন ধান। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা। এক সময়ের এই প্রমত্তা তিসত্মা যেভাবে ধূ ধূ বালু চরে পরিণত হচ্ছে, এ পরিসি’তি চলতে থাকলে উত্তারাঞ্চলের কোন কাজেই আসবে না বিপুল পরিমান অর্থে নির্মিত এই বৃহত্তর সেচ প্রকল্পটি। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, পানি কমে গেলেও এখন পর্যনত্ম সেচের কোন সমস্যা হয়নি। তবে আশা করা যাচ্ছে সমস্যা হলে তা দ্রম্নত সমাধান করা সম্ভব হবে।
সম্পাদনা/নূরনবী আহমেদ /১২.০২ঘ /১৮ ফেব্রয়ারি