অনলাইন ডেস্কঃ- এক প্রকল্পের আওতায় সাগরের বুকে ক্লাস করছে জার্মানির কিছু স্কুল ছাত্রছাত্রী৷ মাস ছয়েক চলে এই ক্লাস৷ শিক্ষার্থীরা হাতেকলমে জীববিদ্যা শেখে প্রবাল প্রাচীরের কাছে৷ ভূগোল শেখে আগ্নেয়গিরির পাদদেশে৷ জাহাজে ক্লাস চলছে। ‘টোর হাইয়ারডাল’ জাহাজটি ঝোড়ো হাওয়ায় দুলতে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়ে ১৬ বছরের ছাত্র সিলাস ইউর্কাট৷ কিন্তু জাহাজের মাস্তুল বেয়ে ওঠা, রেন ফরেস্টের ভেতর দিয়ে হাঁটা, সাদামাটা নৌকার ভেতরে আদিবাসী কোনো ইন্ডিয়ানের পাশে বসে পড়া – এ সব কিছু যেন অনেকটাই ক্ষতিপূরণ করে দেয়।অক্টোবর মাস থেকে সারা জার্মানি থেকে আসা ৩৩ জন অন্যান্য ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে পালতোলা জাহাজে করে অ্যাটলান্টিকের ওপর দিয়ে জ্ঞান অন্বেষণে যাত্রা করছে সে৷ মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়লেও এই শিক্ষা ভ্রমণকে বাদ দিতে রাজি নয় সিলাস৷ ‘পালের নীচে ক্লাসরুম’-ইউনিভার্সিটি এয়ারলাঙেন-ন্যুর্নব্যার্গ–এর উদ্যোগে ‘পালের নীচে ক্লাসরুম’ নামে প্রকল্পটি যাত্রা শুরু করে ২০০৮ সালে৷ তারপর থেকে এই প্রকল্পের আওতায় ছয়বার শিক্ষাসফরে বের হয়েছে ‘টোর হাইডারডাল’ জাহাজটি৷ প্রতি বছর ১৬ জন নাবিক, ৫ জন শিক্ষক ও গিমনাসিউম বা হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ৩৪ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে টেনেরিফ, গ্রানাডা, পানামা, কিউবা ও আসোরেস-এর দিকে যাত্রা করে নৌযানটি৷কঠিন পরিশ্রম করতে হয়-অ্যাডভেঞ্চারের মতো শোনালেও আসলে কিন্তু কঠিন পরিশ্রম করতে হয় শিক্ষার্থীদের৷ একই সাথে তারা জাহাজের কর্মীও৷ পাল ঠিকঠাক করতে হয় তাদের, পাহারা দিতে হয়, রান্না করতে হয়৷ অবশ্যই ক্লাসও করতে হয়৷ সংকীর্ণ জায়গায় ১৯০ দিন ১২০০ সমুদ্র মাইল পার করা – এ জন্য প্রয়োজন ভাল নার্ভ, টিমে কাজ করার দক্ষতা এবং শৃঙ্খলা৷অনেক সময় গ্রুপে থাকতে থাকতে বিরক্তও লাগে৷ ‘‘কিন্তু আমরা এখানে নিজেকে সরিয়ে না রেখে সব কিছু নিয়ে আলাপ আলোচনা করি৷” জানায় ১৫ বছরের ছাত্রী জো৷ এখানে অনেকের সাথে বন্ধুত্বও হয়ে যায়৷ শিক্ষকদের সাথে সম্পর্কটাও বন্ধুসুলভ৷এই শিক্ষাভ্রমণে যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের স্কুলের ক্লাস করা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়৷ জনপ্রতি মাসে খরচ পড়ে ২৭০০ ইউরো৷ ছাত্রছাত্রীদের পরিবারকেই এটা বহন করতে হয়৷ ‘‘তবে এই শিক্ষাভ্রমণ শুধু বিত্তশালীদের জন্যই নয়৷” বলেন প্রকল্পের পরিচালক রুট মার্ক৷ এজন্য বৃত্তির ব্যবস্থাও রয়েছে৷ সিলাস আংশিক বৃত্তি পেয়ে অংশ নিচ্ছে এই প্রকল্পে৷ বাকি টাকা সে কাজ করে উপার্জন করেছে বেশ কিছু বিষয় পড়ানো হয়-সব মিলিয়ে ‘জাহাজের ক্লাসে’ ১০টি বিষয় পড়ানো হয়৷ জীববিজ্ঞান ইংরেজি ও গণিতের পাশাপাশি নৌযাত্রা সম্পর্কিত বিশেষ কিছু বিভাগও রয়েছে কর্মসূচিতে৷ ‘‘আমরা এই জাহাজটিকে ছোট আকারে সমাজেরই এক প্রতিচ্ছবি বলে মনে করি৷ একসাথে বসবাস, কাজ ও শিক্ষাগ্রহণ করতে হয় শিক্ষার্থীদের৷ এটা স্বাভাবিকভাবেই এক বড় চ্যালেঞ্জ৷” বলেন প্রকল্পের পরিচালক মার্ক৷ তিনি জানান. এই ধরনের উদ্যোগ ক্যানাডা, সুইডেন, ও নেদারল্যান্ডস-এও রয়েছে৷প্রতি বছর ২০০ ছাত্রছাত্রী এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য আবেদন করে থাকে৷ ৫০ জনকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়৷ শেষ পর্যন্ত ৩৪ জনকে নির্বাচন করা হয়৷ কৌতূহল, আন্তরিকতা ও প্রণোদনার পাশাপাশি পরীক্ষায় ভাল গ্রেডও চাওয়া হয়৷ লক্ষ্য করা গেছে, এই শিক্ষাভ্রমণের পর অনেকের পরীক্ষার ফলাফল আরো ভালো হয়েছে৷ প্রকল্পের পরিচালক মার্ক এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, জাহাজে তাদের যে সব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়, তা তাদের দায়িত্বশীল ও পরিপক্ক করে তোলে৷ অন্যদিকে বহু গাণিতিক ফাংশনও হাতে কলমে শিখতে পারে তারা৷ ডুব সাঁতার দিয়ে প্রবাল প্রাচীরের কাছাকাছি এসে সাগরের ইকোলজিক্যাল সিস্টেম ও জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে জানতে পারে কিশোর-কিশোরীরা৷ ‘প্রতিরোধের মাঝে শিক্ষা’-এই কর্মসূচির আরেকটি লক্ষ্য ‘প্রতিরোধের মাঝে শিক্ষা’৷ বলেন মার্ক৷ প্রতি দেশে আমরা সর্বোচ্চ পর্বতে আরোহণ করি৷পানামার ৩,০০০ মিটার উঁচু ‘ভলকান বারু’তে ওঠা জেরোর জন্য কষ্টকর হলেও ছিল এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা৷ তারপরের দিন আবার রেন ফরেস্ট বা অতিবৃষ্টি অরণ্যে আদিবাসীদের কুটিরে যাওয়া ও খোলা আগুনে রান্না করাও কম আনন্দদায়ক ছিল না৷ ‘‘আমাদের ভ্রমণে খাওয়াদাওয়াও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়৷” বলেন মার্ক৷ জাহাজে খাওয়াদাওয়া রেশন বা নির্দিষ্ট পরিমাণে বরাদ্দ করা থাকে৷ তাই বুঝেশুনেই খেতে হয় সবাইকে৷ একটি টিশার্টের চেয়ে চকলেটের একটি বার অনেক লোভনীয় তাদের কাছে৷ এতে করে শিক্ষার্থীরা সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন হয়৷ আদিবাসীদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ও কিউবায় অতিথি পরিবারের সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়ে পরিপক্ক হয়ে ওঠে তারা৷ ‘‘আমাদের মধ্যে অনেকেই দারিদ্র্য ও সামাজিক ন্যায়বিচার সম্পর্কে সংবেদনশীল হয়৷ হয়ে ওঠে আত্মনির্ভরশীল ও সাবালক৷ ” বলে জো৷ এ প্রতিবেদনটি ডিডাব্লিউ ।