দুষপ্রাপ্যতার কবলে চাঁদপুরের রূপালী ইলিশ

১ কেজির একটি ইলিশের দাম এখন ১৭শ’ থেকে ১৮শ’ টাকা

মোঃ সাইদুল হাসান,জি নিউজঃ দুপুর দেড়টার ঢাকার এক বন্ধু সোহেল কে সাথে নিয়ে ২ বন্ধু জিসান, রাজীব বড় ইলিশ কেনার জন্য আড়তে আড়তে ঘুরেছেন। রাজীব চাঁদপুর সরকারি কলেজের প্রানীবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র আর জিসান চাঁদপুর পলিট্যাকনিকেল ইনস্টিটিউট-এর শেষ বর্ষের ছাত্র। তাদের বাড়ি চাঁদপুর হলেও শহরের মমিন পাড়ায় থাকেন। বন্ধু সোহেল চাঁদপুর থেকে ইলিশ মাছ ঢাকায় নেয়ার জন্য মাছ ঘাটে এসেছেন। এক/দেড় ঘণ্টা ঘুরে নজর“ল ইসলামের আড়ৎ থেকে বড় সাইজের ২টি ইলিশ পছন্দ করেন। ওই দুটি ইলিশের ওজন ২ কেজি ৬৪০ গ্রাম হয়, যা ১ হাজার ৮শ’ টাকা কেজি দরে ৪ হাজার ৮শ’ টাকায় ক্রয় করেন।

মাছের এতো দাম দেখে জিসান বলে উঠেন, চাঁদপুরের মানুষের জন্য ইলিশ হারাম হয়ে গেছে।

ইলিশের রাজধানী চাঁদপুরের মানুষ ইলিশের স্বাদ গ্রহণ করতে পারছে না। এর  কারণ এখানকার ইলিশের দাম বেশ চড়া। এখন এক কেজির ১টা ইলিশের মূল্য ১৭ থেকে ১৮শ’ টাকা। ইলিশের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান করে জানা যায়, ইলিশের মওসুম শুর“ হলেও নদ-নদীতে মাছ নেই। ইলিশের দুষপ্রাপ্যতায় ঘাটে বা হাটবাজারে যে ক’টি ইলিশ আসছে তার দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। চাঁদপুর শহরের বিপণীবাগ বাজারের মাছ বিক্রেতা খোরশেদ আলম ও মিন্টু জানান, ‘নামার মাছ আইলে মাছের দাম কমবো।’ লোকাল মাছের দাম অনেক বেশি। ৫/৬শ’ গ্রাম ওজনের কিশোর ইলিশের কেজি ৭শ’ থেকে সাড়ে ৭শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নদীতে মাছ নেই, তাই দাম বেশি। চাঁদপুর মাছ ঘাটের কুলি নজর“ল (৩০) জানায়, ২০/২৫ দিন ঘাটে বিচরণ করছি, মাছ কম কাজও কম। বেলা ১১-১২টার দিকে অল্প অল্প মাছ আসে। ঘাটের আড়ৎদার মমিন চোকদার (৬০) জানান, আমাদের কিসমত থেকে ইলিশ মাছ যাইতেছে গিয়া। জেলেরা ইলিশের মাও মারে, চাও মারে। সারা বছরই ৯ ইঞ্চির নিচে ছোট ইলিশ বড় হবার আগেই ধরে ফেলছে। তাই মাছ কমে যাচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাছ ঘাটের আরেক পাইকার জানান, সব জাতের পোনা মাছ ধরে ফেলার কারণে এখন নদ-নদীতে মাছ আগের মতো পাওয়া যাচ্ছে না। ইলিশের আমদানিও খুবই কম। প্রতিদিন ৬০/৭০ মণ ছোট বড় ইলিশ চাঁদপুর ঘাটে আসে। ওই মাছের চালান চলে যায় দেশের বড় বড় শহরে। এ কারণে চাঁদপুরের মানুষ ইলিশ খেতে পায় না। যাদের সামর্থ্য আছে তারা এর স্বাদ নিতে পারে।

সরজমিনে মঙ্গলবার চাঁদপুর মাছ ঘাটে জি নিউজ-এর এ প্রতিনিধি গিয়ে জানতে পান, গত বছর এ সময় ইলিশের বেশ আমদানি ছিলো। ছোট, মাঝারি ও বড় এ তিন সাইজের ইলিশের মণ ছিলো ১৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা। এখন এ সময়ে সে মাছের দাম ২৫ হাজার থেকে ৩০/৩৫ হাজার টাকা। রায়পুর উপজেলার হায়দারগঞ্জের বেপারী বাচ্চু মজুমদার (৪০) জানিয়েছেন, আগে তাদের ঘাট থেকে প্রতিদিন ৮/১০ মণ ইলিশ বিক্রির জন্য চাঁদপুর ঘাটে আনা হতো। এখন নদীতে মাছ এতোই কম, যে কারণে মঙ্গলবার মাত্র দেড়-দুই মণ ছোট ইলিশ আনতে পেরেছেন। তার মতে, সরকার এবার জাটকার যে অভিযান চালিয়েছে, এটা কোনো অভিযানই নয়। জেলেরা প্রচুর জাটকা ধরে নিয়েছে।

শহরের কয়লাঘাট গিয়ে দেখা যায় ডাকাতিয়া নদীতে সারিবদ্ধ ৫/৭টি ইলিশ শিকারের গুল্টি জেলে নৌকা। শরীয়তপুরের ঘরিসা রামবদ্ধপুর, ডামুড্ডা থেকে চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে ইলিশ শিকারে এসেছে জেলেরা। কৃষ্ণ বর্মণের জেলে নৌকার জেলে নন্দ বর্মণ জানায়, ১৫/১৬ দিন নদীতে জাল বেয়ে যাচ্ছি। নদীতে মাছের দেখা পাচ্ছি না। কোনো রকম খাওয়া খরচ হয়। বৃষ্টির পানি নামার কারণে পানি ঘোলা তাই মাছও নেই। জাটকা মাছ ধরা না হলে কিছু মাছ এখন তারা পেতো। একমাস এভাবেই যাবে। আশায় আছে সামনে মাছ ধরা পড়বে। পুরাণবাজার হরিসভা এলাকায় সেলিম শেখের নৌকার জেলে ফার“ক (৩০) জানান, ১০ দিন জাল বেয়ে ৮ হাজার টাকা দেনা। নৌকা খরচ ৩ হাজার টাকা। মাছ পাচ্ছি ১২ থেকে ১৫শ’ টাকার।

মওসুমের শুর“তেই ইলিশের দুষপ্রাপ্যতা, অস্বাভাবিক দাম এবং চাঁদপুরের সাধারণ মানুষ কেন ইলিশ কিনে খেতে পারছে না, কোথায় যায় ইলিশ এসব বিষয় কথা হয় চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের ইলিশ গবেষক মৎস্য বিজ্ঞানী ড. আনিছুর রহমানের সাথে। তিনি জানান, ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ইলিশ সংরল¶ণ কার্যক্রম জোরদার না হওয়ায় এর প্রভাব ইলিশ সিজনের উপর পড়ছে। খারাপ আবহাওয়ার দর“ণ সাগর থেকে জাঁকে জাঁকে ইলিশ নদীতে আসতে পারছে না। জাটকা ও কিশোর ইলিশ নিধন বন্ধ হলে ইলিশ উৎপাদনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাবে।

চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কৃষিবিদ রতন দত্ত জি নিউজ বিডি ডট নেট কে জানান, এখনো ইলিশের ভর মওসুম শুর“ হয়নি। জুন, জুলাই, আগস্ট মাস ইলিশের ভরা মওসুম। তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হতে থাকবে। আর ওই সময় ইলিশের ফেভারিট সময়। ৩১ মে পর্যš— জাটকার অভিযান চলমান। তিনি আরো জানান, জলবায়ুর অনেক পরিবর্তন ল¶্য করা যাচ্ছে। তারপরও বঙ্গোপসাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। ওই মাছ চাঁদপুর ঘাটে না আসার কারণ কী জানতে চাওয়া হলে রতন দত্ত জি নিউজকে জানান, অফিসিয়ালি ইলিশ রপ্তানি বন্ধ। কারণ, দেশের মানুষ যাতে ইলিশ খেতে পারে। কিন্তু দুষ্ট চক্র উপকূলীয় এলাকা থেকে ইলিশ পাচার করে দেয়। এ জন্য ওই এলাকার ইলিশ চাঁদপুরে আসছে না। এ দিকে একটি সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সময়ে চাঁদপুর মেঘনা নদীর নৌ সীমানায় এবং পদ্মা নদীর কিছু অংশে যে পরিমাণ ইলিশ আহরিত হয় এর সিংহভাগই চাঁদপুরে নিয়ে আসা হয়। বড় বড় ইলিশ বাছাই করে কোল্ডস্টোরেজে বন্দী করে রাখা হচ্ছে। এ সুযোগে ইলিশের চড়া দামও হাঁকিয়ে নিচ্ছে একটি মহল। তাই সাধারণ মানুষ অনেক বেশি দাম হবার কারণে ইলিশ পাচ্ছে না।

 

সিনিয়র রির্পোটার/ জি নিউজ

Exit mobile version