অনলাইন ডেক্সঃ- ইউরোপের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে খ্যাত সুইডেনের উমেয়ো শহরের বিশ্ববিদ্যালয়টির সুনাম শিক্ষা জগতে ছড়িয়ে পড়েছে৷ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে তত্ত্বাবধান করা হয় এই শিক্ষালয়ে৷ শিক্ষার্থীরাও এতে খুব সন্তুষ্ট৷
ছুটিতে জনশূন্য
জার্মান ছাত্রী আন-কাট্রিন বেক উমেয়োতে এসে কাউকে না দেখে প্রথমে একটি ঘাবড়েই গিয়েছিলেন৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আমি উমেয়োতে এলাম, কিন্তু কোনো মানুষজন নেই৷ ইউনিভার্সিটি থেকে হোস্টেলের পথে কারো সঙ্গে দেখা হয়নি৷”
রাষ্ট্র ও প্রশাসন বিজ্ঞানের এই ছাত্রী সেমিস্টার শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ আগেই উত্তর সুইডেনের উমেয়ো শহরে এসে পৌঁছান৷ সত্যি বিস্ময়ের ব্যাপার৷ কেননা বিশ্বের নানা দেশ থেকে আসা ৩৮,০০০ শিক্ষার্থী ও কর্মীর পদচারণায় মুখর থাকে ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস৷ কিন্তু সেমিস্টারের ছুটি বলে একেবারে জনশূন্য৷ বলা বাহুল্য, ৮০,০০০ বাসিন্দার উমেয়ো শহরটি ইউনিভার্সিটিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত৷ সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সব দিক থেকেই৷
প্রাণ চঞ্চল বিশ্ববিদ্যালয়
সেমিস্টার চলাকালে অবশ্য দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র৷ সব ফ্যাকাল্টিই প্রাণ চঞ্চল৷ মূল ভবনের করিডোরে তরুণ-তরুণী, প্রফেসর ও শিক্ষকরা দ্রুত পায়ে ক্লাস রুমে ঢোকেন৷ শোনা যায় নানা ভাষায় কলকাকলি৷
জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলের ছোট্ট শহর বাড বুখাউ থেকে এসেছেন আন-কাট্রিন৷ তাঁর সহপাঠিনী আনা রাইখ এসেছেন হেসেন রাজ্যের আরেক ছোট শহর হের্বশ্টাইন থেকে৷ ইতোমধ্যে দু’জনেরই এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের রকম-সকম সম্পর্কে একটা ধারণা হয়েছে৷
ক্যান্টিনের খাবারের দামটা বেশি৷এটা বিবেচনা করে অনেকগুলি মাইক্রোওয়েভ রাখা হয়েছে ক্যান্টিনে৷
২১ বছর বয়সি আন-কাট্রিন বলেন, আমি সুইডেনে যেতে চেয়েছি, যেহেতু স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় আমি কখনও যাইনি এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে সুইডেনের সুনাম রয়েছে৷”
চরম কিছু করা
কিন্তু রাজধানী স্টকহোলম বা দক্ষিণের শহরগুলি তাঁকে আকৃষ্ট করেনি৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আমি চরম কিছু করতে চেয়েছি৷ ম্যাপে দেখলাম সুইডেনের একেবারে উত্তরের শহর উমেয়ো৷ ভাবলাম নিশ্চয়ই সেখানে একঘেয়ে লাগবে না৷”
তাঁর সহপাঠী ২৩ বছর বয়সি আনা বিশেষ করে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পড়ানো হয় বলে সুইডেনের এই শহরটি নির্বাচন করেন৷ তবে অন্য ভাষা শেখার ব্যাপারেও তাঁর আগ্রহ রয়েছে৷ তাই সুইডিশ শেখার সুযোগটা তিনি নিয়েছেন৷
‘লাইফ লং লার্নিং‘ প্রোগ্রাম
দু’জনেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘লাইফ লং লার্নিং’ প্রোগ্রামের এরারমুস কর্মসূচির আওতায় সুইডেনে পড়াশোনা করতে এসেছেন৷
বিদেশি শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে তথাকথিত এক ‘বাডি প্রোগ্রামে’-র উদ্যোগ নেন কর্তৃপক্ষ৷ বাডিরা হলেন সুইডিশ ছাত্রছাত্রী৷ তারা বিদেশি সহপাঠীদের সুইডিশ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন৷ প্রথমে অনেকে একত্রিত হন৷ তারপর ছোট ছোট দল গড়ে ওঠে৷ সুইডিশ বাডিরা নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের আয়োজন করেন৷ করেন এক সঙ্গে রান্নাবান্না, যেমন সুইডেনের ঐতিহ্যবাহী শটবুলার বা ছোট ছোট মাংসের বল৷ কিংবা তৈরি করেন ক্র্যানবেরির জেলি৷ ‘‘না চাইলে কেউ এখানে একাকিত্বে ভুগবে না”, বলেন আনা রাইখ৷
ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে দিক নির্দেশনা ও ভাষা কোর্স দেওয়া হয়৷ এছাড়া উমেয়ো অঞ্চল ও কোর্স সম্পর্কে বহু ভাষায় হোম পেজ রয়েছে৷
জার্মানিতে শিক্ষার্থীরা যেভাবে বসবাস করেন
অনিশ্চয়তা
নতুন সেমিস্টার শুরু হয়েছে, কিন্তু হোস্টেলগুলোতে জায়গা নেই৷ এখন শিক্ষার্থীরা কি করবে? মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই তো চাই! একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে! মিউনিখ এবং ফ্রাংকফুর্ট সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর৷ বাভারিয়া রাজ্য একটি ঘর ভাড়া গড়ে ৪৯৩ ইউরো আর ফ্রাংকফুর্টে ৪২১ ইউরো৷
জার্মানিতে শিক্ষার্থীরা যেভাবে বসবাস করেন
মায়ের কাছে থাকা
শতকরা ২৭ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনার সময় মায়ের কাছেই থাকে৷ এতে করে শুধু যে খরচ কম হয় তা নয়, মায়ের কাছে থাকার আরামই আলাদা৷ কাপড়চোপড় সবসময় ধোঁয়া থাকে আর ফ্রিজ থাকে ভর্তি, অর্থাৎ খাওয়া-দাওয়ার চিন্তা নেই৷ তাছাড়া সন্তান যত বড়ই হোক না কেন বাবা-মায়ের কাছে তারা সবসময়ই আদরের৷
জার্মানিতে শিক্ষার্থীরা যেভাবে বসবাস করেন
জরুরি অবস্থায় জিমে থাকা
প্রথম সেমিস্টারে প্রায় সমস্যা হয় বড় শহরগুলোতে, বিশেষ করে মিউনিখ, কোলোন বা ফ্রাংকফুর্টে৷ এত ভাড়া দিয়ে অনেকের পক্ষেই বাসা নেওয়া সম্ভব হয় না, তাই অনেক সময় ক্যাম্পাসের জিমে একটি ম্যাট্রেস পেতেই রাতে ঘুমোতে হয়৷
জার্মানিতে শিক্ষার্থীরা যেভাবে বসবাস করেন
হোস্টেলে জায়গা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার!
শতকরা মাত্র ১২ জন ছাত্র হোস্টেলে জায়গা পেয়ে থাকে৷ বেশিরভাগ সময় সেখানে দুই তিনজনকে একসাথে থাকতে হয়৷ কোলোনের একটি ছাত্রদের হোস্টেলের ভাড়া ২৩০ ইউরো৷
জার্মানিতে শিক্ষার্থীরা যেভাবে বসবাস করেন
থাকার জন্য কন্টেনার
৮০’র দশক থেকেই অনেক ছাত্র কন্টেনার-এ থাকা শুরু করে৷ কন্টেনার ঘরগুলো খুবই ছোট ছোট৷
জার্মানিতে শিক্ষার্থীরা যেভাবে বসবাস করেন
নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে থাকা
কোনো কোনো মালিক তাঁদের ফ্যাক্টরি, হাসপাতাল বা স্কুলের ঘরগুলো একেবারে খালি রাখতে চান না৷ তাই অনেক সময় ছাত্রদের নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে সেখানে থাকতে দেন৷ তবে সেখানে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়৷ যেমন ধূমপান করা, কুকুর-বেড়াল পোষা বা কোনো ধরনের পার্টি করার অনুমতি থাকেনা সেখানে৷
জার্মানিতে শিক্ষার্থীরা যেভাবে বসবাস করেন
বিদায় বাড়ি !
তবে সব শিক্ষার্থী কিন্তু বাবা-মায়ের সাথে থাকতে পারেনা কারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রায়ই থাকে বাড়ি থেকে অনেক দূরে৷ অর্থাৎ মায়ের হোটেল থেকে এবার বিদায়ের পালা!
প্রতিবেদন: সুজানে কর্ড / এনএস | সম্পাদনা: জাহিদুল হক
বিস্তৃত এলাকা জুড়ে হোস্টেল
আর শুরু থেকেই হোস্টেলে সিট ঠিক করে রাখা হয় বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য৷ শহরের একটা অংশের পুরোটা জুড়েই রয়েছে ছাত্র হোস্টেল৷ বাথরুমসহ ২৪ বর্গমিটারের প্রশস্ত কক্ষ পাওয়া যায়৷ শিক্ষার্থী, বিশেষ করে বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের সুযোগ-সুবিধার দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার কারণে ২০১২ সালে দ্বিতীয় বারের মতো ‘সুইডেনের ইউনিভার্সিটি’ হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে উমেয়ো বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্ট৷ অন্যান্য মূল্যায়নেও ওপরের দিকে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি৷
এটির ক্যাম্পাসে রয়েছে চারটি অনুষদ: কলা, মেডিসিন, কারিগরি ও বিজ্ঞান এবং সমাজ বিজ্ঞান৷ শহরের এক প্রান্তে ১৯৬৫ সালে স্থাপিত হয়েছে উমেয়ো বিশ্ববিদ্যালয়টি৷ আধুনিক ভবনের পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে টলটলে জলাশয়৷ মনোরম এক পরিবেশ৷
তবে ক্যান্টিনের খাবারের দামটা বেশি৷ এটা বিবেচনা করে অনেকগুলি মাইক্রোওয়েভ রাখা হয়েছে ক্যান্টিনে৷ শিক্ষার্থীরা সাথে আনা খাবার সেখানে গরম করতে পারেন৷
শুরুটা কনকনে শীতে না হলেই ভালো
তবে বিদেশি শিক্ষার্থীরা কোর্সের শুরুটা উত্তর সুইডেনের এই অঞ্চলে শীতকালীন সেমিস্টারে না করলেই ভালো করবেন৷ সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায়ই অনবরত তুষারপাত হতে থাকে৷ এক মিটারেরও বেশি উঁচু বরফ ডিঙিয়ে চলাচল করতে হয় সবাইকে৷ দুপুর একটাতেই আঁধার নেমে আসে৷ তবে কর্তৃপক্ষ এটা বিবেচনা করেই দিবালোকের অনুকরণে ৩০ বর্গমিটার আয়তনের আলোকোজ্জ্বল একটি কক্ষ ঠিক করেছেন৷ ঘরটির ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত সবই শ্বেত বর্ণের৷ এমনকি আসবাবপত্রও সাদা রঙের৷ ঘরে ঢুকলেই পাখির কিচির মিচির শোনা যাবে সিডি প্লেয়ার থেকে৷
দুই জার্মান ছাত্রীই খুশি
উমেয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক পরিবেশে পড়াশোনা করতে পারায় আন-কাট্রিন ও আনা রাইখ – এই দুই জার্মান ছাত্রীই খুশি৷ আন কাট্রিন বলেন, ‘‘আমি হেসেনের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসেছি৷ সেখানে তুর্কি সম্প্রদায়ের লোকজনও খুব বেশি নেই৷ আর এখানে তো এক তুর্কি ছাত্রীর সঙ্গে বসবাসই করি আমি৷ এখানে এসে মনে হচ্ছে আমি সত্যি সত্যি ইউরোপীয়৷ আমার মতে, আরো বেশি শিক্ষার্থীর বিদেশে যাওয়া এবং এই ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করা উচিত৷ খবর DW DEএর