জি নিউজ, ডেস্কঃ- মধ্য কলকাতার যৌনপল্লী সোনাগাছিতে গিয়েছিলাম দুর্গাপূজা শুরুর ঠিক আগের দিন। সেন্ট্রাল এভিনিউয়ের একদিকে একের পর এক পূজামণ্ডপ আলোয় সেজে উঠেছে, মাইকে গান বাজছে। কিন্তু অন্য দিকটা কিছুটা অন্ধকার – এই দিকে কোনো পূজা হচ্ছে না। রাস্তায় সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছেন প্রচুর মহিলা – খদ্দেরের অপেক্ষায় থাকতে থাকতেই অনেকেই দেখেছি তাকিয়ে আছেন রাস্তার অপর পারের আলোগুলোর দিকে। প্রতিবছর সোনাগাছির বাসিন্দাদের এভাবেই অন্যান্য – তথাকথিত ভদ্র পাড়ার পূজার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, সেখানেই যেতে হয় প্রতিমা দর্শন করতে। গিয়ে হেনস্থাও হতে হয়। কিন্তু এই প্রথম নিজেদের পাড়ায় দুর্গাপূজা করছেন সোনাগাছির যৌনকর্মীরা। সোনাগাছির ভেতরে খদ্দের আর দালালদের ভিড়ে পাশ কাটিয়ে একটু এগোতেই ছোট্ট প্যান্ডেল। ভেতরে একচালা দূর্গা প্রতিমা – সঙ্গে হাজির লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ। এখানকার দূর্গা এলোকেশী – পড়নে লালপাড় গরদ।প্রতিমা তৈরি করেছেন কুমোরটুলির যে শিল্পী, সেই অশোক পাল বলছিলেন,“প্রতিমা যখন গড়েছি, তখন আমার মাথায় এক নারীর রূপ ছিল। সেটা যৌনপল্লীর মেয়েও হতে পারে, আমার আপনার ঘরের মেয়েও হতে পারে। যৌনপল্লীর মেয়েরাও তো সমাজেরই অংশ – তারা তো সমাজের বাইরে নয়। এটা ভেবেই আমি ঠাকুরটা গড়েছি। যৌনকর্মীদের সংগঠন দূর্বারের সদস্যরা এই পূজার আয়োজন করেছেন। সংগঠনের সম্পাদিকা ভারতী দাসের কাছে বলছিলেন তারা তো অনেক অধিকার থেকেই বঞ্চিত হন, কিন্তু দুর্গাপূজা করার অধিকার আদায় করার কথা তারা বিশেষ করে ভাবলেন কেন। সবাই পূজা করে। আমাদেরও তো ইচ্ছে থাকে অঞ্জলি দেব, উপোস করব। কিন্তু সেটা করতে পারি না। পূজার চাঁদা নেয়ার সময়ে কিন্তু সবাই আসে। কিন্তু পূজায় গেলেই লোকে ব্যঙ্গ–বিদ্রুপ করে – শুনতে হয় – এরা তো যৌনকর্মী – এদের আবার কীসের অঞ্জলি, কীসের উপোস ,ভারতী দাস বলছিলেন, “দশমীর দিন সিঁদুর খেলার সময়ে যদি আমরা কেউ এগিয়ে যাই আমাদের বলা হয় যৌনকর্মীদের আবার সিঁদুর খেলা কী? আমাদের তো স্বামী থাকে না। এই দৃষ্টিভঙ্গিটাই তো মারাত্মক। সেখান থেকেই আমাদের নিজেদের পূজা করার ভাবনা। শুধু পূজার সময় নয়, যৌনকর্মী বা তাদের সন্তানদের হেনস্থা হতে হয় বছরভরই।সোনাগাছির প্রবীণ যৌনকর্মী পূর্ণিমা চ্যাটার্জী বলছিলেন, “এই যে ব্যবহার বাইরের মানুষেরা আমাদের সঙ্গে করে, তাতে কিন্তু আমরা খুবই দুঃখ পাই। আমরা তো সমাজ থেকেই এসেছি – সমাজের বাইরে তো নই আমরা। তাহলে আমাদের কেন অচ্ছ্যুত করে রাখা হয়। যৌনকর্মীর সন্তান সানি মুখার্জি বলছিলেন, “ক্লাস ফাইভ অবধি পড়ে স্কুল ছাড়তে হয় আমাকে। ক্লাসের অন্য ছেলেরা টিটকিরি দিত যৌনকর্মীর ছেলে বলে। খারাপ গালাগালিও দিত। তাইজন্যই স্কুল ছাড়তে হয়েছে। যৌনকর্মীদের যারা প্রকাশ্যে অচ্ছ্যুত মনে করেন বা হেনস্থা করেন, তাদের অনেকেই আবার রাতে যৌন পরিষেবা কিনতে সেই সোনাগাছিতেই যান – এটা কলকাতার বাঙালি মধ্যবিত্তদের একটা বড় দ্বিচারিতা বলছিলেন কয়েক দশক ধরে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা চিকিৎসক ও দুর্বারের প্রধান উপদেষ্টা ডা. স্মরজিৎ জানা।তিনি বলেন, “যে লোকেরা রাতে যৌন পরিষেবা কিনতে আসেন, সকালবেলা তাদের রূপ পাল্টে যায়। আবার সেইভাবে হয়তো যারা যৌন পরিষেবা কিনতে আসেন না, অথচ কথায় কথায় সমাজ পরিবর্তনের কথা বলে গলা ফাটান, তাদেরও যখন বলতে গেছি, যে বয়স্কা যৌনকর্মীরা পেশা ছেড়ে দিতে চাইছেন, তাদের বাড়িতে কাজের লোক হিসাবেই রাখুন না আপনি, তখন আমাকে শুনতে হয়েছে, ওরে বাবা না না, আমার বাড়িতে না। এতটাই হিপক্রিট সমাজ। পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কমিশনের প্রধান সুনন্দা মুখার্জীর ব্যাখ্যা – পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই দ্বিচারিতার পেছনে রয়েছে একটা দর্শন।“পুরুষতন্ত্রের একটা দীর্ঘমেয়াদী ব্যধির শিকার হয়ে এই মেয়েদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। সমাজ তো এখনও পিতৃতন্ত্রের, পুরুষের অঙ্গুলি হেলনে পরিচালিত হয়। এই যে একটা অন্যায় সমাজে চলে আসছে, সেটার পেছনে রয়েছে একটা শক্তিশালী দর্শন। পুরুষের প্রয়োজনেই যৌনপল্লী তৈরি হয়, আবার তাদের নির্দেশেই সেখানকার মানুষদের বিচ্ছিন্ন করে রাখা। এই ঘেরাটোপে একটু হলেও ফাটল ধরল সোনাগাছির দুর্গাপূজা দিয়ে,” বলছিলেন মিসেস মুখার্জী। অন্য পাড়ায় পূজায় গিয়ে হেনস্থার হাত থেকে বাঁচতে নিজেদের পাড়ায় পূজা করার কথা ভাবা এক, আর সেই পূজার বাস্তবায়ন যে আরও কঠিন, সেটা পদে পদে টের পেয়েছেন যৌনকর্মীরা..প্রথমেই বাধা এসেছিল পুলিশের কাছ থেকে। দুর্বার সাংগঠনিকভাবে অভিযোগ জানিয়েছিল যে পুলিশ পূজার সময়ে যে বাড়তি তোলা বা চাঁদা আদায় করে সোনাগাছি থেকে, সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাতেই যৌনপল্লীতে পূজা হতে দিতে চায় নি তারা। তারপরে কলকাতা হাইকোর্ট অবধি দৌড়তে হয়েছিল তাদের। শেষমেশ আদালতের নির্দেশেই সোনাগাছিতেও এবার দুর্গাপূজা হচ্ছে। কোনো যৌনপল্লীতে এই প্রথমবার পূজা। অথচ যে যৌনপল্লীর মাটি বহু যুগ ধরেই দুর্গাপূজার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে রয়েছে সেই যৌনকর্মীদেরই পূজার সময়ে ব্রাত্য করে রাখা হয়, হেনস্থা করা হয়..বলছিলেন ভারতী দাস। হিন্দুশাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ চর্চাকেন্দ্র বলে পরিচিত ভাটপাড়ার শাস্ত্রজ্ঞ দেবপ্রসাদ ভট্টাচার্য বলছিলেন সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা অনেক শতাব্দী ধরেই শাস্ত্রের নাম করে দুর্গাপূজায় যৌনকর্মীদের বিভিন্নভাবে যুক্ত করে রেখেছে।এটাকে আমরা দুদিক থেকে ব্যাখ্যা করতে পারি। প্রথমটা ধর্মীয় দিক। যখন কোনো পুরুষ যৌনপল্লীতে যান, তখন তিনি বারবণিতার বাড়ির সামনে দরজায় ধর্মকে রেখে যান। অর্থাৎ তিনি যে মহিলাকে উপভোগ করতে গেলেন, সেটাকে ধর্ম স্বীকৃতি দিল না – অনৈতিক বলে আখ্যা দিল। আর যেহেতু ধর্মের অবস্থান বারবণিতার দরজায়, তাই সেই জায়গাটা পবিত্র বলে মনে করা হয়। অথচ, ব্রাহ্মণের বাড়ির মাটি কিন্তু ব্যবহার করা হয় না – যে ব্রাহ্মণরা হিন্দু ধর্মের নিয়ন্ত্রক।ভট্টাচার্য বলছেন এছাড়াও বারবণিতাদের প্রসঙ্গটা দুর্গাপূজার ক্ষেত্রে বারে বারেই এসেছে। যেমন দশমীর দিন যে বিসর্জনের শোভাযাত্রা হবে, সেখানে বারবণিতাদের নাচ ও গান একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আর সেই গান হতে হবে অশ্লীল – যৌনাঙ্গ নিয়ে অশ্লীল কথা থাকতে হবে – সেটাই শাস্ত্রের নির্দেশ। আর সেটা না করলে দেবী সাংঘাতিক অভিশাপ দেবেন, সেটাও শাস্ত্রে লেখা হয়েছে। দুর্গাপূজার ব্যবস্থা আসলে একটা মহাকাব্যিক আঙ্গিকে তৈরি। সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারা বিভিন্ন সময়ে এতে মিশেছে আর মূল পূজার অনুষঙ্গ হিসাবে ঢুকে গেছে।” তিনি বলছিলেন। যে হিন্দু গ্রন্থ চন্ডী দুর্গাপূজার আকর গ্রন্থ, সেই চন্ডীতে যৌনপল্লীর মাটি ব্যবহারের অন্য একটা সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করছিলেন নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ।পূজায় যা যা লাগে তার একটা অন্যতম উপাদান যৌনপল্লীর মাটি। যতটা চন্ডী পড়েছি, তাতে আমার এটাই মনে হয়েছে যে ওই মাটি ব্যবহারের কারণ হলো, সেখানে গিয়ে পুরুষেরা বীর্য ফেলে আসেন। তাই ওই মাটিতে পুরুষের সব গুণ রয়েছে। অর্থাৎ দূর্গার মধ্যে পুরুষের সেই সব গুণ আরোপ করার জন্য যৌনপল্লীর মাটির প্রয়োজন। যদিও অসুরদের কাছ থেকে রাজ্যপাট ফিরিয়ে নিতে যে দূর্গা তৈরি হলো, নারীর রূপ দেয়া হলেও সেটা কিন্তু তার মধ্যে যুদ্ধাস্ত্রের সঙ্গেই পুরুষের যাবতীয় গুণ আরোপ করার জন্যই যৌনপল্লীর মাটির ব্যবহার। এই ব্যাখ্যা শুনলে কি এটাই মনে হয় না, যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জন্য যৌনপল্লীতে যেতে বাধ্য হয়েছেন, দুর্গাপূজার মাধ্যমে সেই পুরুষতন্ত্রের কাছেই কি আবারও মাথা নোয়াচ্ছেন যৌনকর্মীরা? মিসেস ঘোষের কথায়, আংশিকভাবে সেটাই ঘটনা, তবে দুর্গাপূজার মতো একটা সামাজিক উৎসবের মধ্যে যে আনন্দ-উদ্দীপনা থাকে, সেখানে অংশ নেয়ার অধিকারও সব মানুষের মতোই যৌনকর্মীদেরও রয়েছে। যৌনকর্মী বা তাদের সন্তানেরাও গূঢ় তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মধ্যে এখন আর যেতে চান না। তারা এখন ভাবছেন দুর্গাপূজার কটা দিন কীভাবে উপভোগ করবেন সকলে মিলে। পূজার সময়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য নাচ আর গানের দলের রিহার্সাল চলছে – ঠিক অন্যান্য পাড়ার পূজায় যেমন মহড়া হয়ে থাকে। ইতিমধ্যেই ঠিক হয়ে গেছে কারা পূজার ভোগ রাঁধবেন, কারা পাড়ার সকলের জন্য খিচুড়ি রাঁধবেন, কারা ভ্যানরিক্সায় করে সেটা বিলি করবেন। যৌনকর্মী আর যৌনকর্মীদের সন্তানেরা শেষ বেলার যোগাড়যন্ত্র নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত – কোথা থেকে পদ্মফুল আনা হবে, পূজার ব্যবস্থা করার জন্য যে লালপাড় শাড়ি পড়তেই হবে – কানে আসছিল সেই সব কথা। তবে উৎসবের আনন্দের মাঝেই সবাই খুশি নতুন অধিকার অর্জন করতে পারার জন্য। সূত্র: বিবিসি । তাঃ- ১১ অক্টোবর, ২০১৩