ভিন্ন মাত্রায় এবার এসেছে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি এমনিতেই বাঙালী জাতির জন্য অনন্য এক দিন। তারপরও ঢাকার শাহাবাগের প্রজন্ম চত্বর থেকে সারা দেশে গড়ে ওঠা আন্দোলন এবারের একুশে এক অন্যরকম মাত্রা যোগ করেছে। এবারের একুশে ফেব্রুয়ারি আর পাঁচটি বারের মতো গতানুগতিকতায় পালিত হচ্ছেনা। এবারের একুশে যুক্ত হয়েছে তারুণ্যের দ্রোহ। যে দ্রোহ থেকে সারা দেশে একযোগে শ্লোগান উঠছে ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই-রাজাকরের ফাঁসি চাই।’ একই সাথে শ্লোগান উঠবে ‘জামায়াত- শিবিরের রাজনীতি-বন্ধ করো করতে হবে।’ এমন ঘটনা যেমন এবারেই প্রথম, তেমনি ৬১ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম আজকের দিনে মহা সমাবেশ ডাকা হয়েছে। এ দ্রোহ, এ তেজ দীপ্ত তারুণ্য এবারের একুশ সব বছরের চাইতে বাঙালীর জীবনে এসেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রায়।
আজ থেকে ৬১ বছর আগে মাতৃভাষার জন্য বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত দিয়েছিল এই দিনটির জন্য। পৃথিবীর ইতিহাসের আর কোনো জাতির ভাষার জন্য রক্ত জড়ানোর ইতিহাস নেই। তাই অমর একুশ তারুণ্যের অহংকার। সেই তারুণ্য দীর্ঘদিন পর হলেও ঘুরে দাড়িয়েছে। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের একটি রায়কে কেন্দ্র করে তরুণ প্রজন্ম আবারও জেগে উঠেছে। শাহবাগের এ গণআন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। যা বাঙালী জাতির জন্য নতুন এক ইতিহাস।
তারুণ্যের এ জয়গান এখন দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বময়। বীর বাঙালীর আত্মবলিদানের ইতিহাস আজ ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সীমানা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে গেছে। কারণ একমাত্র বাঙালী জাতিরই রয়েছে বিশ্বে মাতৃভাষার জন্য জীবন বলিদানের নজিরবিহীন ইতিহাস। যার ফলশ্রুতিতে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেসকো ১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। এরপর থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে ঘটেছিল বাঙালির ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার ঘটনা। আর ‘বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা’ শ্লোগানে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় প্রাণ অকাতরে বিলিয়ে দেয় তরুণরা। একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষাশ হীদদের স্মরণে ‘জাতীয় শহীদ দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পালিত হয়।
ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে বৃহস্পতিবার ভোরের শিশির মাড়িয়ে প্রভাতফেরিতে খালি পায়ে শহীদ মিনার অভিমুখে এগিয়ে যাবে নারী, শিশু, বৃদ্ধসমেত অগণিত মানুষ। শহীদ মিনারের বেদিমূল ভরে উঠবে ভালোবাসা অর্ঘ্যে। রাষ্ট্রীয় আয়োজনে ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরাসহ দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণীর মানুষ।
১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে একুশে ফেব্রুয়ারিকে শোক দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের রীতি চালু হয়। একুশের পথ ধরে শুরু হয় বাঙালীর স্বাধিকার সংগ্রাম। জন্ম নেয় স্বাধীন রাষ্ট্র। তাই একুশ আজ পালিত হয় বাঙালীর জাতিসত্তা বিকাশের অনন্য দিন হিসেবে। এমন দিনকে হেলাফেলা করতে চায়নি তরুণ সমাজ। তাইতো আজ অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রেখে ২১ ফেব্র“য়ারি আবার শাহবাগে মহাসমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ।
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি এবং জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে প্রজন্ম চত্বরে অবস্থান থেকে সোমবার রাতে এই কর্মসূচির ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।
২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে প্রথম প্রহরে গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে ফুল দেয়া হবে।
দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শহীদ মিনারে বিকাল ৩টায় একযোগে একুশের গান গাইতে গণজাগরণ মঞ্চ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে।
ইমরান বলেন, “মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যেগুলোতে শহীদ মিনার নেই, তা ২১ ফেব্র“য়ারির মধ্যেই নির্মাণ করতে হবে।”
২১ ফেব্রুয়ারির আগের দিন ২০ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪টা ১৩ মিনিটে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের উদ্দেশে দেশের প্রতিটি মানুষকে একটি করে চিঠি লিখে তা একটি বেলুনে বেঁধে ওড়ানোর কর্মসূচি পালন করে গণজাগরণ মঞ্চ।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ১৩ মিনিটে পাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেছিল বলে এই কর্মসূচি পালনের জন্য এই সময়টি বেছে নিয়েছে ৪২ বছর পরের এই আন্দোলনকারীরা।
সোমবার জামায়াতে ইসলামীর ডাকা হরতালের সকালে রাজধানীর শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে একাত্মতা জানায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সদস্যরা।
এই আন্দোলনে দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থনের পর যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করেছে সরকার।
আইন সংশোধনের ফলে আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার রায়ের বিরুদ্ধে যেমন সরকার আপিল করতে পারবে, তেমনি যুদ্ধাপরাধের জন্য দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীরও বিচার করা যাবে।
এ অর্জন এদেশের তরুণ প্রজন্মের। এ আন্দোলন নতুন মাত্রায় আত্ম প্রকাশ করবে আজ। গোটা জাতি আজ তাকিয়ে আছে আজকের দিকে।
সম্পাদনা/শাবানা মন্ডল /০২.২৫ঘ /২১ ফেব্রয়ারি