রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বন্ধ হচ্ছে না খুনোখুনি, বাড়ছে উদ্বেগ

অনলাইন ডেস্কঃ- মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলির কারণে রোহিঙ্গা শিবির দিন দিন অস্থির হয়ে উঠছে। ফলে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে অবস্থানরত সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার মাঝে দেখা দিয়েছে চরম অস্থিরতা। অন্যদিকে ক্যাম্পে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, গ্রুপে-গ্রুপে গোলাগুলি, আধিপত্য বিস্তার, মাদক, অস্ত্রসহ নানা সহিংসতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গেল ৪ মাসে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে খুন হয়েছে ১৫ জন রোহিঙ্গা। নিহতদের অধিকাংশই ক্যাম্পের নেতা বা স্বেচ্ছাসেবক। এ নিয়ে কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারাও চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫শে আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১১৫টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে গত ৪ মাসে ১৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।
উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্পে আর্মড পুলিশ ৩টি ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে। এপিবিএন এর তথ্য মতে, ২২শে সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ এরশাদ (২২) নামে একজন স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ২১শে সেপ্টেম্বর খুন হন মোহাম্মদ জাফর (৩৫) নামের এক নেতা (মাঝি)। ১৮ই সেপ্টেম্বর খুন হন আরেক স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ ইলিয়াস (৩৫)।
৯ই আগস্ট দুই রোহিঙ্গা নেতা, ৮ই আগস্ট টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ১লা আগস্ট একই ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নেতা মারা যান। ১লা আগস্ট উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক, গত ২২শে জুন কথিত আরসা নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং ১৫ই জুন একই গ্রুপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। ১৬ই জুন রাতে উখিয়া ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক, ১০ই জুন কুতুপালংয়ের ৪ নম্বর ক্যাম্পের আরেক স্বেচ্ছাসেবক, ৯ই জুন এক রোহিঙ্গা নেতা, জুনের শুরুতে মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানাউল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬)।
৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ জানান, ২০২১ সালের ২২শে অক্টোবর ক্যাম্প-১৮ এর একটি মাদ্রাসায় ৬ জনকে হত্যা করা হয়। এর আগে ২৯শে সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয় রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহকে। এসব হত্যাকাণ্ডের পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিয়ে সকলেই যখন উদ্বিগ্ন, তখন বিকল্প হিসেবে চালু হয় স্বেচ্ছায় পাহারার। ক্যাম্পটির প্রতিটি ব্লকে ৫ জন করে রাতে স্বেচ্ছায় পাহারা দেয়া শুরু করে। এরপর পর্যায়ক্রমে ৮ এপিবিএন এর আওতাধীন ১১টি ক্যাম্পের ৬৪টি ব্লকের ৭৭৩টি সাব-ব্লকে চালু হয় এ স্বেচ্ছায় পাহারার ব্যবস্থা। প্রতিরাতে ৩ হাজার ৮৬৫ জন রোহিঙ্গা পাহারা দিচ্ছে ১১টি ক্যাম্পে। তারা কোনো সন্দেহজনক লোকের আনাগোনা, চিহ্নিত অপরাধী, মাদক বেচাকেনাসহ নানা অপরাধের তথ্য দিচ্ছে এপিবিএনকে।
তিনি জানান, গত ২৩শে অক্টোবর থেকে চালু হওয়া স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থার কারণে ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মতো অপরাধ কমেছে কয়েকগুণ। অপরদিকে মাদক উদ্ধার বেড়েছে ৩ দশমিক ৬৬ গুণ, অস্ত্র উদ্ধার বেড়েছে ৬ দশমিক ৫ গুণ আর গ্রেপ্তারের সংখ্যা বেড়েছে ৩ দশমিক ৬৩ গুণ। ফারুক আহমেদ জানান, জামতলী ক্যাম্প থেকে চালু হওয়া স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা এখন উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলছে। তিনি জানান, স্বেচ্ছায় পাহারা দেয়ার এই পদ্ধতির কারণে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা প্রতিবন্ধকতায় পড়েছে। যার জের ধরে এসব অপরাধীরা এখন স্বেচ্ছাসেবক এবং মাঝিকে প্রতিপক্ষ হিসেবে টার্গেট করেছে। এতে স্বেচ্ছাসেবক ও মাঝিরাও হত্যার শিকার হচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে ক্যাম্পের নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে।
অভিবাসন ও রোহিঙ্গা বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর মানবজমিনকে জানান, ‘রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ স্বদেশে ফেরত নিতে কাজ শুরু করেছিলেন। আন্তর্জাতিক মহলে হয়ে উঠেছিলেন রোহিঙ্গা মুখপাত্র হিসেবে। মহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠা মেনে নিতে না পেরে রোহিঙ্গাদেরই একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে মামলার তদন্তে উঠে এসেছে।’
তিনি জানান, ‘মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডটি সুনিদিষ্ট টার্গেট কিলিং হিসেবে ধরা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মুখপাত্র হয়ে ওঠা এবং হওয়ার চেষ্টা করছে এমন মানুষকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় খুন করা হচ্ছে বলে মনে হয়। এখানে ভিন্ন কোনো মহলের ইন্ধন থাকতে পারে।’
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ বাড়ায় উদ্বিগ্ন ক্যাম্পের আশপাশের লোকালয়ের বাসিন্দাসহ পুরো কক্সবাজার জেলাবাসী। উখিয়ার কুতুপালং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হেলাল উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, ‘ক্যাম্পের পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ক্যাম্পভিত্তিক মাঝি (নেতা), সাব-মাঝি, স্বেচ্ছাসেবকদের খুন করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তাদের অবস্থান ঘোষণা করে যাচ্ছে।’ বাহারছড়া ইউপির চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, ‘মানবিক কারণে আশ্রয় দেয়া রোহিঙ্গারা এখন স্থানীয়দের কাছে আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। তারা প্রতিনিয়ত মাদক, মানব পাচার, অবৈধ অস্ত্র, স্বর্ণ চোরাকারবারি, অপহরণ, খুনসহ নানা অপকর্ম করেই যাচ্ছে। কক্সবাজার পিপলস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল মানবজমিনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা স্বাভাবিকভাবে নেতা মানতে চান না। কেউ নেতা হয়ে উঠবে বা তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে তা না মানার প্রবণতা তাদের রয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাদের নেতৃত্বশূন্য করার কোনো মিশন সশস্ত্র গোষ্ঠী বা ভিন্ন কোনো মহল পরিচালনা করছে কিনা তা খতিয়ে দেখা জরুরি।’
কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মাহাবুবুর রহমান অভিযোগ করেন, ‘কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির জন্য মূলত রোহিঙ্গারা দায়ী। এখানে যে পরিমাণ অপরাধ এখন হচ্ছে, তা অতীতে কখনো হয়নি। রোহিঙ্গারা ভাড়ায় খুন থেকে শুরু করে অপরাধমূলক নানা কাজে জড়িয়ে পড়ছে।’
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আয়াছুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যেভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। যতই সময় গড়াচ্ছে, ততই তারা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। এখনই যদি তাদের লাগাম টেনে ধরা না হয়, তবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।’ রোহিঙ্গাদের দ্রুত মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কক্সবাজারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কথা স্বীকার করেছেন। কক্সবাজার র‌্যাব-১৫-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খায়রুল ইসলাম সরকার। খবর মানবজমিন ।
রোহিঙ্গাদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ চলছে জানিয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে জেলা পুলিশের পাশপাশি ক্যাম্পে এপিবিএন’র ৩টি ব্যাটালিয়ন কাজ করছে। পাশাপাশি র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ সেখানে কাজ করছে।’

Exit mobile version