একটি ক্লাসরুম
অনলাইন ডেস্ক:- সারসংক্ষেপ : কোন কিছু গড়তে হলে, সৃষ্টি করতে হলে প্রয়োজন দক্ষ ও বিবেকবান কারিগরের। যাদের অবদানে পৃথিবীতে অমরত্ব লাভ করেছে অনেক সৃষ্টি। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকই যদি প্রকৃত অর্থে শিক্ষক না হন, তাহলে কে গড়বে মানুষ। মহানবী (সা.) নিজে দার্শনিক, রাষ্ট্রনায়ক, সেনানায়ক ধরনের কোন অভিপ্রায় প্রকাশ করেন নি। তিনি বলেছেন “আমি শিক্ষক রূপে প্রেরিত হয়েছি।”
শিক্ষক হচ্ছেন জাতির বিবেক, মানুষ গড়ার কারিগর। পার্সিডেন রেন বলেছেন- “শিক্ষক শুধু খবরের উৎস বা ভাণ্ডার নন, কিংবা প্রয়োজনীয় সর্বপ্রকার তথ্য সংগ্রহকারী নন, শিক্ষক শিক্ষার্থীর বন্ধু, পরিচালক ও যোগ্য উপদেষ্টা, শিক্ষার্থীর মনের বিকাশ সাধনের সহায়ক তথা তাদের চরিত্র গঠনের নিয়ামক।”
ভূমিকা :
আভিধানিক অর্থে- শিক্ষা হচ্ছে, শেখা, অভ্যাস, অধ্যয়ন, জ্ঞানার্জন, চারিত্রোন্নতি। সু-অভ্যাস বা ক্রমাগত অনুশীলন শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ। ল্যাটিন শব্দ Educo থেকে ইংরেজী Education শব্দের উৎপত্তি। Educo শব্দের মূলগত অর্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- E = Out; duco = to lead, to draw out বা পরিচালিত করা, বের করা, প্রতিভাত করা। Education এর তাৎপর্য হচ্ছে, মানব মনের সহজাত বৃত্তি বা সম্ভাবনাকে বিকশিত ও পরিচালিত করাই শিক্ষা। এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ইউরোপীয় E (ই) উপসর্গের একটা অর্থ অভাব আর এক অর্থ বর্হিগমতা; Educate শব্দের উৎপত্তিমূলক অর্থ বহির্ণয়ন। এই অর্থ-সূত্রেই তিনি বলেছেন, “আমাদের যে শক্তি আছে তাহারই চরম বিকাশ হইবে, আমরা যা যাহা হইতে পারি, তাহা সম্পূর্ণভাবে হইব- ইহাই শিক্ষার ফল।” মোটকথা, মানুষের অন্তর্নহিত গুণাবলীকে স্ফুরিত, নিগরিত ও নিয়ন্ত্রিত করে জীবনের নানা প্রয়োজেনে তাকে উক্ত গুণগুলো প্রয়োগ করার শক্তি ও নৈপুণ্য দান করাই শিক্ষা।
শিক্ষা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া (Process) :
শিক্ষা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া (Process) এ প্রক্রিয়া শিক্ষার্থীর জীবনে যে পরিবর্তন আনে তাকে ধীরে ধীরে উন্নত জীবন যাপনে সাহায্য করে ও সমাজে স্বনির্ভর সুনাগরিক রূপে বসবাস করার যোগ্যতা দান করে। শিক্ষা তো শুধু শিক্ষক, শিক্ষার্থী আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠনের সংখ্যা দিয়ে বিচার করা যায় না। তার চয়ে বড় কথা হল, বিভিন্ন স্তরে কি শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, কিভাবে শেখানো হচ্ছে, সে শিক্ষা শিক্ষার্থীরা কতখানি গ্রহণ করতে পারছে, যতটা তারা গ্রহণ করছে, তাতে সমাজের উপর কতখানি কল্যাণকর প্রভাব পড়ছে -এ সবের বিচার মাপকাঠি দিয়ে করা শক্ত; কিন্তু তবুও এ বিচার ছাড়া শিক্ষা ক্ষেত্রের অগ্রগতি বিবেচনা অর্থহীন থেকে যায়।
শিক্ষাকর্মের মূলবিষয় :
শিক্ষাকর্মের মূলবিষয় শেখা ও শেখানো। তবে শেখার পদ্ধতি ও শেখানোর নিয়মকানুন এমন হওয়া চাই, যাতে শিক্ষক শিক্ষার্থীর আন্তরিক সহযোগিতায় শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষাদানের কাজটি সম্পন্ন করতে পারেন। শিক্ষার সামগ্রিক প্রক্রিয়া মূলত শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষণীয় বিষয় সম্পর্কিত উপকরণ ও পদ্ধতিকে ঘিরেই চলে। শিক্ষানতত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, সচলতা, সক্রিয়তা, গতি এবং শক্তি। এই গতি ও শক্তি শিক্ষালদ্ধ অভিজ্ঞতাকে প্রয়োজন অনুযায়ী কার্যকর করার নিশ্চয়তা দেয়। তাহলে শিক্ষার সাফল্য কিভাবে প্রমাণিত হবে? এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, শিক্ষালদ্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে যথাসময়ে যথাস্থানে প্রয়োগ করা, অর্জিত জ্ঞানকে এক ক্ষেত্র থেকে অপর ক্ষেত্রে ব্যবহার করার সক্ষমতা শিক্ষার সাফল্য প্রমাণিত করে।
শিক্ষাদানের সাধারণ নীতি :
শিক্ষাদানের সাধারণ নীতি সকল শিক্ষকের জন্য অনুসরণীয়।
১. শিক্ষক শিক্ষার্থীকে পাঠ গ্রহণে উপযোগী মানসিক প্রস্তুতি দান করবেন। তাকে সক্রিয় এবং সজিব করে তুলবেন।
২. শিক্ষার্থীকে শুধু পাঠ্যপুস্তকের নীরস পরিবেশে আবদ্ধ না রেখে সৃজনশীলতার উন্মেষণ সাধন করবেন।
৩. শিক্ষাদান হবে উদ্দেশ্যমূলক। বিষয় উপস্থাপনের পূর্বে শিক্ষক পাঠদানের প্রস্তুতি নিবেন। যাতে শ্রেণীর পরিবেশ স্বাচ্ছন্দ হয়, শিক্ষার্থীর পাঠ গ্রহণ হয় সুন্দর ও সার্থক।
শিখন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্র :
বিখ্যাত শিক্ষা বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন স্যামুয়েল ব্লুম (Benjamin Samuel Bloom) দীর্ঘ গবেষণা করে ১৯৫৬ সালে শিক্ষার্থীর শিখন প্রক্রিয়াকে তিনটি ক্ষেত্রে (Domain) ভাগ করেছেন :
১. বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র (Cognitive Domain)
২. আবেগীয় ক্ষেত্র (Affective Domain)
৩. মনোপেশিজ ক্ষেত্র (Psychomotor Domain)
৪. বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র (Cognitive Domain): মস্তিস্কই আমাদের বুদ্ধিভিত্তিক ক্ষেত্র। মানুষ কোন বই পুস্তক, পত্র-পত্রিকা পড়ে সিনেমা নাটক দেখে কোন অনুষ্ঠান বা আলোচনা শুনে নিজের মধ্যে যে জ্ঞানমূলক দক্ষতা তৈরি করে তাকে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র বা চিন্তন দক্ষতার ক্ষেত্র বলে। এ ক্ষেত্রের বিভিন্ন স্তর রয়েছে –
মূল্যায়ন
সংশ্লেষণ
বিশ্লেষণ
প্রয়োগ
অনুবাধন
জ্ঞান
৫. আবেগীয় ক্ষেত্র (Affective Domain): শিক্ষার্থীর আবেগেরে বিভিন্ন দিক ধীরে ধীরে গড়ে উঠে।
যেমন-
আত্মস্থকরণ (Internalizing)
মূল্যবোধ সংগঠন (Organizing)
মূল্যবোধ বিচারকরণ (Valuing)
সাড়া প্রদান (Respond)
গ্রহণ (Receiving)
৬. মনোপেশিজ ক্ষেত্র (Psychomotor Domain) : এ ক্ষেত্রে মন এবং পেশির সমন্বয় করে শিক্ষার্থী কোন বিষয় হাতে কলমে শিখে। সকল ব্যবহারিক এবং ট্রেড জাতীয় বিষয এ শিখন ক্ষেত্রের আওতাভুক্ত। এ শিখন প্রক্রিয়াটি শিক্ষার্থীরা ধাপে ধাপে শিখে। নিম্নের চিত্রটি লক্ষ্য করি-
স্বাভাবিকীকরণ (Naturalization)
শিল্পিতকরণ (Articulation)
যথার্থকরণ (Precision)
নিপুণতার সাথে কার্যসাধন (Manipulation)
অনুকরণ (Imitation)
শিক্ষা বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন স্যামুয়েল ব্লুম দেখিয়েছেন, শিখন প্রক্রিয়াটি যে ক্ষেত্রেই ঘটুক না কেন, তা ধাপে ধাপে বা স্তরে স্তরে সম্পাদিত হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন শিক্ষাবিজ্ঞানী এ বিষয় আরও গবেষণা করে নতুন ধারনা প্রদান করেন।
নিম্নের চিত্রটি লক্ষ্য করি –
শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া :
শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ একটি দ্বিমুখী আনন্দময় স্বচ্ছন্দ প্রক্রিয়া। তাই শিখন শিখানো কথাটি দ্বিমুখী অর্থবহন করে। শ্রেণীতে পাঠদানের দু’ রকম পদ্ধতি আছে-
১. শিক্ষক কেন্দ্রিক ২. শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক
শিক্ষককেন্দ্রিক পদ্ধতিতে শিক্ষকের ভূমিকাই মূখ্য, এই পদ্ধতি গতানুগতিক ও বৈচিত্রহীন। এখানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ থাকে না। আর শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর ভূমিকাই মূখ্য থাকে। শিক্ষকরা যদি উভয় পদ্ধতিতে পাঠদান করেন তবে যে সকল সুফল বয়ে আনবে তা হল –
ক. শিক্ষার্থীকে বিষয়বস্তু অনুধাবনে সক্ষম করে তোলে।
খ. শিক্ষার্থীর মত প্রকাশের অনুভুতিতে নাড়া দেয়।
গ. শিক্ষার্থীর আচরণের সাথে বিষয়বস্তুর একটা তুলনামূলক স্থায়ী সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।
ঘ. মুখস্থ করার প্রবনতা দূর হয় এবং সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে।
শিখন পদ্ধতি ও কৌশল :
আমাদের জীবনে অনেক শিক্ষকেরই প্রভাব রয়েছে। আমরা এখনও অনেক শিক্ষকের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি ব্যক্তি মানুষটির জন্য নয়, পড়ানোর কৌশলের জন্য, যা আমাদের বিবেকবোধ, আবেগ অনূভূতিতে নাড়া দেয়। সুতরাং শিক্ষকের পেশাগত উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীর আচরণিক পরিবর্তনে শিক্ষক যে সকল শিখানো পদ্ধতি ও কৌশল অনুসরণ করতে পারেন, পরিবেশ ও শিক্ষার্থীর মান বুঝে তা অবলম্বন করা উচিত, যেমন-
১. বক্তৃতা (Lecture) ২. বক্তৃতা আলোচনা (Lecturette)
৩. স্থান পরিদর্শন (Site Visit) ৪. প্রদর্শন (Demonstration)
৫. শিক্ষামূলক ভ্রমণ ও মাঠ পরিদর্শন (Study tour & Field work)
৬. দলীয় আলোচনা (Group Discussion)
৭. প্যানেল ডিসকাশন (Panal Discussion)
৮. ঘটনা বিশ্লেষণ (Case Study) ৯. ব্রেইম স্টর্মিং (Brain storming)
১০. ভূমিকানয়ন (Role Play) ১১. পাঠ নির্দেশনা (Guided Study)
১২. সিমুলেশন খেলা (Simulation Play)
১৩. প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি (Question-Answer Method)
১৪. সতীর্ত দলভিত্তিক শিখন (Peer Group Learning)
১৫. সমস্যা সমাধান (Problem Solving Learning)
১৬. পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষাদান (Interactive teaching).
অষ্ট্রেলিয়ার ৭০ বছর বয়স্ক একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, Learning just a fun অর্থ্যাৎ শিক্ষণ হচ্ছে একটা মজা। বস্তত: একজন শিক্ষক শিখন- শিখানো পদ্ধতি ও কৌশল অবলম্বন করে শিক্ষাদান পরিবেশটাকে আকর্ষণীয়, আনন্দময় ও মজাদার করে তুলবেন।
শিক্ষকের দায়িত্ব ফ্যাসিলেটেটর (Facilitator), স্যার জন এ্যাডমস শিক্ষককে “মানুষ গড়ার কারিগর” (A Maker of Man) বলেছেন, আবার আধুনিক শিক্ষাবিদরা বলেন- শিক্ষক হচ্ছেন “ÒA Teacher is a Change Maker” অর্থাৎ পরিবর্তনকারী সমাজ ও শিক্ষার্থীর জীবন এবং জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি। তাই ফলপ্রসু শিখন প্রক্রিয়ায় শিক্ষক ফ্যাসিলেটরের (Facilitator) অর্থাৎ সহায়তাকারীর ভূমিকায় অবর্তীণ হয়ে কিছু দায়িত্ব পালন করবেন।
যেমন –
১. সংগঠক ২. উদ্ভাবক ৩. শ্রেণী ব্যবস্থাপক ৪. প্রদর্শক ৫. পরিচালক
৬.. ন্যায় বিচারক ৭. উদ্ধুদ্ধকারী ৮. পরামর্শ দানকারী ৯. অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ১০. পরিকল্পনাকারী ১১. স্বপ্ন দ্রষ্টা।
একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে জীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ী হওয়ার উপদেশ দেবেন। জীবনের স্বপ্ন পূরণের কথা তিনি এ ভাবে বলবেন- “Dream is not what you see in sleep, is the think which does not let you sleep
শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন :
একজন শিক্ষক কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে উপনীত হতে পেরেছেন কি না এ জন্য শিক্ষার্থীকে দুভাবে মূল্যায়ন করবেন –
ক. গঠনকালীন/ ধারাবাহিক মূল্যায়ন (Formative Assessment)
খ. চূড়ান্ত/ সামষ্টিক মূল্যায়ন (Summative Assessment)
পাঠ চলাকালীন শ্রেণীকক্ষে যে মূল্যায়ন হয় (চূড়ান্তভাবে মূল্যায়নের পূর্বে) এটাই ধারাবাহিক মূল্যায়ন।
ক. এই মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সবলতা ও দুর্বলতা চিহ্নিত করে ফিডব্যাক প্রদানের মাধ্যমে তাদেরকে চূড়ান্ত মূল্যায়নের জন্য উপর্যুক্ত করে গড়ে তোলা হয়।
খ. সামষ্টিক বা চূড়ান্ত মূল্যায়ন দ্বারা শিক্ষার্থীদের পাস বা ফেল নির্ধারণ করে তাদের সাফল্যের তুলনামুলক অবস্থান নির্ণয় করে গ্রেড বা সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়।
শিক্ষকের আত্ম মূল্যায়ন:
শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের পর আসবে শিক্ষকের নিজকে মূল্যায়ন করার পালা। তথাকথিত পরিচিতি বাক্য- “Teachers like poets are born not made” কবির মত শিক্ষকও জন্ম গ্রহণ করেন, তাঁকে তৈরি করা যায় না। ‘এই উক্তিটির সম্পুর্ণ স্বীকার করা যায় না, তেমনি পুরোপুরি অস্বীকার করার অবকাশও নেই।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- “যেখানে অধ্যাপকগণ জ্ঞানের চর্চায় স্বয়ং প্রবৃত্ত, সেখানেই শিক্ষার্থীগণ শিক্ষাকে প্রত্যক্ষ দেখতে পায়”। শিক্ষকতার মূল উপাদান শিক্ষাগ্রহীতা, শিক্ষাদাতা, শিক্ষা প্রক্রিয়া এবং শিক্ষার বিষয় – এ চারটি ক্ষেত্রের বিচিত্র পরিবেশে যিনি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষ গড়ার কাজে নিমগ্ন থাকবেন ; তাকেই শুধু সহজাত প্রতিভার অধিকারী হলেই চলবে না। শিক্ষা প্রক্রিয়ায় শিক্ষককে অধ্যয়ন ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে নিজ পেশার উপযোগী জ্ঞান, দক্ষতা এবং জ্ঞান অভিজ্ঞতা প্রয়োগের নৈপূণ্য অর্জন করতে হবে। সহজাত অর্জিত গুণাবলীর অধিকার সম্পন্ন যে কোন শিক্ষকই শিক্ষকতার জীবনে প্রথম দিন থেকেই সুশিক্ষকরূপে গণ্য হতে পারেন- এ ধরনের আশা করা যায় না। কেননা শিক্ষকতার কোন্ পর্যায়ে তিনি কতটা বিশ্বস্ততার সঙ্গে তাঁর কর্তব্য পালন করেছেন, শিক্ষার পরিবেশ তার কাজের অনুকুল ছিল কি না, শিখন ফল অর্জিত হয়েছে কি না, শিক্ষার্থীদের বিষয়বস্তুর সাথে সংযোগ তৈরি হয়েছে কি না, ইত্যাদির মূল্যায়ন প্রয়োজন। শিক্ষকের ব্যক্তি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য যেমন প্রতিটি শিক্ষকের পরিচায়ক, গুণগত বৈশিষ্টও তেমনি তার পরিচয়ের অপরিহার্য অংশ। শিক্ষকতার সার্থকতা তার সাধনাশীল কর্মতৎপরতার ওপর নির্ভর করে। এই সার্থকতা লাভ করতে হলে তাকে নিজকে সহকর্মীদের দ্বারা সতীর্থ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আত্মমূল্যায়নের স্বচ্ছ আলোতে আত্মোন্নয়ন করতে হবে। তিনি নিশ্চিত জানবেন যে, আত্মসমীক্ষার ফল সর্বদাই সুখকর বা আশাপ্রদ হবে না, তবে আশাবাদী মনোভাব নিয়ে সযত্ন প্রয়াসের মাধ্যমেই তিনি নিজ আচার আচরণের বাঞ্চিত পরিবর্তন সাধনে সক্ষম হতে পারেন।
আমেরিকার মনোবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ডেভিড. এ.কব (David. A. Kold) ১৯৭০ সালে Experimental Learning মডেল উদ্ভাবন করেন এবং ১৯৮৪ সালে পুস্তক আকারে প্রকাশ করেন। শিক্ষা বিজ্ঞানে এ তত্ত্বটি বহুল সমাদৃত। “কব” এর তত্ত্বে ৪টি উপাদান চক্রাকারে কার্যকর থাকে। এই মডেলে “Reflective Practices” এর উপর জোর দেয়া হয়েছে। এটি এমন এক কার্যকর উপায় যা শিক্ষককে তার দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে। শ্রেণী কক্ষে শিক্ষক যা করেন তা যদি প্রতিনিয়ত মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করেন, তবে তার শিখন সমৃদ্ধ করা সম্ভব। শিক্ষক নতুন ধারণা বের করবেন, সততার সাথে শ্রেণীকক্ষে নিজের কৃতিত্ব/দক্ষতা মূল্যায়ন করবেন এবং সমস্যার সমাধান বের করবেন। তিনি বিভিন্ন দিক থেকে জ্ঞান আহরণ করেন (Do), অর্জিত জ্ঞান পরিমার্জিত করে যে কোন পরিবেশ পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়াতে ও প্রয়োগ করতে পারেন (Reflect), নতুন ধারণা শিখেন ও প্রয়োগ করেন (Learn), তিনি সারা জীবন ধরে শেখেন। অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ করেন (Apply)। তিনি একজন সফল শিক্ষক, যিনি ঝুঁকি নিতে সক্ষম, পাঠের গভীরে যান, অন্যদের সাথে তা বিনিময় করেন, খোলাখুলিভাবে উপদেশ দেন ও গ্রহণ করেন। তিনি নিজের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। অর্থাৎ শিক্ষক একজন চিন্তাশীল ও কর্মশীল মানুষ; নতুন ধারণার প্রয়োগকারী এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার্থী। কর্মজীবনের সারাটা সময়ই তিনি অবিরত শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন- শিক্ষা গ্রহণ একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ ধরনের শিক্ষক কখনো ফুরিয়ে যায় না, এই শিক্ষককে বলা হয়, নন ফসিলাইজড শিক্ষক।
সুপারিশ :
১. ‘শিক্ষকতার পেশা অধ্যায়নরত’- মূলমন্ত্রের উপর একজন শিক্ষকের পেশাগত জীবন গঠন করতে হবে।
২. শিখন- শেখানো পদ্ধতিগুলো দক্ষতার সাথে প্রয়োগ করতে হবে।
৩. যে যত বড় মাপের শিক্ষকই হোন না কেন, তাকে শ্রেণী উপযোগী পাঠদান পদ্ধতি প্রয়োগ করার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
৪. শিক্ষকের প্রভাব শিক্ষার্থীর জন্য আদর্শনীয় ও অনুকরণীয় হতে হবে।
৫. শিক্ষক আত্মমূল্যায়নের মাধ্যমে আত্মউন্নয়নে উদ্বুদ্ধ ও উদ্যোগী হবেন।
৬. শিক্ষককে শুধু গবেষক হলে চলবে না ‘A Teacher is a change maker’ এর ভূমিকায় সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হবে।
৭. শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশের জন্য Facilitator (সহায়তনকারী) দায়িত্ব পালননের মাধ্যমে শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন।
উপসংহার :
শিক্ষকদের ব্যক্তিত্বের প্রভাব, শিখন শেখানো পদ্ধতি ও কৌশল, শিক্ষা পরিবেশের নিয়মনীতি, শিক্ষাক্রমের বিষয়ভূক্ত পাঠ্যসূচী প্রভৃতি শিক্ষার্থীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে ক্রমশ সামাজিক মানসিকতার একে বার কাছাকাছি নিয়ে যায়। পরিবার, সমাজ প্রতিষ্ঠান, সবার সাথে শিক্ষার্থীর যোগসূত্র ঘটাতে পারেন শিক্ষকই। তাই শিক্ষক সমাজকে আরও গুণগতমান অর্জনের প্রতি উদ্যোগী হওয়া বাঞ্চনীয়। জাতির হৃদপিণ্ড শিক্ষাকে সঠিক যত্নে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব শিক্ষক সমাজের। সারাদেহের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে যেমন মানুষ মারা যায়। একজন শিক্ষক পাঠদান পদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর যদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেটির বিস্তরণ না ঘটান, তবে শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে ব্যর্থ, শিক্ষাদান প্রক্রিয়াটি হবে সময়ক্ষেপন বই আর কিছু নয়।
তথ্যসূত্র :
1. London, J (1994, 3rd edn) The principle of teaching and class management, London. – Alfred M. Holder.
2. Park, A.B.R (1986), The Principles and practice of teaching London, – Blackie & Son.
3. Filch, Sin. J.G . (1881) Lectures on Teaching. Cambridge (CUP)
4. Gerlick, A.H. (1896) A new manual of Method, London, Longmans, Green & Co.
5. Gladman F.J (1877) School Method, London, Jarrold & Sons.
৬. শিক্ষা জগৎ – শাওয়াল খান।
৭. সুশিক্ষক – মঞ্জুশ্রী চৌধুরী।
৮. জাতীয় শিক্ষাক্রম- ২০১২।খবর:রেডিও তেহরান ।
লেখক: নাসিমা বেগম,
এম.এস.এস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বি.এড. এন্ড মাস্টার ট্রেইনার সেসিপ,
বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রভাষক, সমাজ কর্ম বিভাগ
ময়মনসিংহ মহিলা ডিগ্রী কলেজ, ময়মনসিংহ।