সাতক্ষীরা প্রতিনিধি ঃ সাতক্ষীরায় পোশাক শ্রমিকদের সাথে টেইলার্স মালিকদের দরকষাকষি নিয়ে বিরোধের জেরধরে ধর্মঘট অব্যহত আছে। ফলে প্রায় মাসাধিকাল ব্যপি পোশাক শ্রমিকরা তাদের কর্মস্থলে যোগ না দেওয়ায় টেলার্স মালিকরা ইতোপূর্বে নেয়া অর্ডার ফেরত দিচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষ নতুন বস্ত্র তৈরি করতে না পেরে কিনতে বাধ্য হচ্ছে বলে ভুক্তভোগিদের অভিযোগ। এদিকে টেইলার্স মালিকরা অর্ডারীদের কাপড় ফেরত নিয়ে যাবার জন্য শহরে মাইকিং করেছেন। আসন্ন ঈদে টেইলার্স মালিকরা পোশাক তৈরি অর্ডার নিলেও শ্রমিকরা কাজে যোগদান না করায় নির্দিষ্ট সময়ে ডেলিভারি দেয়া সম্ভব নয় বলে ফেরত দেয়া হচ্ছে। এতে করে বিপাকে পড়েছেন গরীব মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাধারণ মানুষ।
শহরের একটি নামকরা টেইলার্সে পাঞ্জাবী তৈরির অর্ডার দিয়েছিলেন আব্দুর রউফ (৬০) নামক এক ব্যক্তি। তিনি মাইকিং শুনে তার পাঞ্জাবীর কাপড় ফেরত নিতে এসে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, বছরে রোজার ঈদে ছেলেরা পাঞ্জাবী বানিয়ে দেয়। সে পাঞ্জাবী পরিধান করে ঈদের জামায়াতে যান। এ বছর তার পাঞ্জাবী বানানো হবে না বলে দু:খ প্রকাশ করেন। শুধু আব্দুর রউফ নয়, এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন শহরের নিউ মার্কেট এলাকায় মহিলাদের জন্য পোশাক তৈরির টেইলার্সে আসা কয়েকজন তরুণী। নতুন পোশাক তৈরির বায়না দিয়ে তারাও পড়েছেন বিপাকে। এদের একজন মনোয়ারা মমতাজ। তিনি বলেন, মালিকরা শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি মেনে নিলে হয়রানি হতে হতো না। সালোয়ার কামিজের অর্ডার দেয়া এ তরুণী বলেন, ঈদ আসন্ন। এখন মালিকরা বলছেন, অর্ডার ফেরত নিতে। এক ঈদে কয়বার পোশাক কেনা যায়? এমন আক্ষেপ করেছেন বেলাল, মারুফ, আফজাল, মিল্টনের মতো অনেক তরুণরাও।
জেলা দর্জি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোজাফফর হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ শাহীদ আকবর জানান, দর্জি শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ টেইলার্স মালিকদের দুই দফায় ১৪ দফা দাবি মেনে নেয়ার জন্য আল্টিমেটাম দেয়া হলেও তারা কোন দাবীর প্রতি শ্রদ্ধা দেখায় নি। ফলে জেলা দর্জি শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কঠোর কর্মসূচি চলছে। ১৪ দফা দাবী গুলোর মধ্যে রয়েছে, কোনো দোকানে দর্জি নিয়োগ ও ছাটাই করতে হলে তা দর্জি শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনা করে করতে হবে। কর্মরত অবস্থায় কোনে কাজের অনিচ্ছাকৃত ক্ষতি হলে তা দর্জি শ্রমিকদের নিকট থেকে মালিক পক্ষ আদায় করতে পারবেন না, প্রত্যেক দর্জি শ্রমিককে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের পরিচয় পত্র দিতে হবে। প্রত্যেক দর্জিকে সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০০ টাকার কাজ দিতে হবে। বছরে এক মাসের সমপরিমান উৎসবভাতা দিতে হবে। এক ঘন্টা বিরতি সহ সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কর্ম সময় নির্ধারণ করতে হবে। বিকাল ৫টার পর কোনো শ্রমিক কাজ করলে তাকে অতিরিক্ত ৫০ ভাগ মজুরী প্রদান করতে হবে। দূর্ঘটনায় পতিত শ্রমিকের চিকিৎসার ব্যয়ভার মালিককে বহন করতে হবে। সকল সরকারি ছুটি কার্যকর করতে হবে। ঈদের দুইদিন আগে দর্জি শ্রমিকদের ছুটি দিতে হবে। এছাড়া শ্রমিকদের মজুরি প্যান্টে ৭২ টাকার পরিবর্তে ১০০ টাকা, শার্টে ৫০ টাকার পরিবর্তে ৭০ টাকা, পাঞ্জাবীতে ৬০ টাকার পরিবর্তে ১০০ টাকা হারে প্রদান করতে হবে। দর্জি শ্রমিক নেতারা বলেন, সাতক্ষীরায় প্রায় ৫হাজার শ্রমিক বিভিন্ন টেইলার্সে কাজ করে। ঈদ আসন্ন। শ্রমিকরা ইতোপূর্বে দুই দফায় ৮ দিন ধর্মঘট পালন করে। তাতেও তারা কর্ণপাত করেনি। বছরে ঈদ পূজায় পোশাক তৈরি করে অর্জিত অর্থ দিয়ে শ্রমিকরা উৎসব পালন করেন। কিন্তু এবারের ঈদে এসব শ্রমিকরা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন। নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে শ্রমিকদের দাবি মেনে নিয়ে কর্মস্থলে ফিরিয়ে আনার আহবান জানান।
এ ব্যাপারে সাত সাতক্ষীরা জেলা টেইলার্স মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, সাত সাতক্ষীরায় দর্জি শ্রমিকরা ১৪দফা দাবি করে ধর্মঘট পালন করছেন। দর্জি শ্রমিকদের দাবি সম্পূর্ণ অন্যায়। প্রতি ঈদের আগে দর্জি শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এভাবে অন্যায় আব্দার করে মালিকদের বিপাকে ফেলে সুবিধা আদায় করে। গত বছরও তারা এভাবে দাবি জানালে সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্সে বসে শ্রমিক ও মালিক পক্ষের মধ্যে দুই বছর মেয়াদী একটি চুক্তিপত্র হয়। সে চুক্তিপত্রের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এগার মাসের মাথায় এসে তারা অযৌক্তিক দাবিতে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, সাতক্ষীরার দর্জি শ্রমিকদের যে দাবি নামা পেশ করেছে তা দেশের রাজধানী সহ আর কোথাও নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খুলনায় একটি থ্রি পিচের মজুরি ৩৭ টাকা, সেখানে সাতক্ষীরা দেয়া হয় ৪২ টাকা। এমনি ভাবে শার্ট, প্যান্ট, কোর্ট, সাফারী পাঞ্জাবী প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে দেশের অন্য যে কোন জেলার চেয়ে সাতক্ষীরায় শ্রমিকদের বেশি মজুরী দেয়া হয়। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শার্টে শ্রমিকদের দাবি ৯০ টাকার চুক্তিপত্র অনুযায়ী দেয়া হয় ৫০ টাকা, প্যান্টে দাবি ১৪০ টাকা, চুক্তিপত্র অনুযায়ী দেয়া হয় ৭২ টাকা। এভাবে প্রতি ঈদের আগে সাতক্ষীরার পোশাক শিল্পকে ধ্বংস করতে একটি মহল মরিয়া হয়ে ওঠে। শ্রমিকদের আমরা আপন ভাই বোনের মতো সম্মান- শ্রদ্ধা করে তাদের সমস্যা সমাধান করি। অথচ তাদেরকে ব্যবহার করে একটি মহল ষড়যন্ত্র করছে। এতে করে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, প্রতি বছর ঈদের সময় দর্জি শ্রমিকরা তাদের কথিত দাবি নিয়ে মালিকদের কাছে হাজির হয়ে না পেলে ধর্মঘটের ডাক দিয়ে জেলাবাসীকে জিম্মি করার একটা প্রথা তৈরি করে ফেলেছে। বরাবরের ন্যায় এবারও সেই ধর্মঘট চলছে। তবে এবার টেলার্স মালিকরা শ্রমিকদের দাবী মানা সম্ভব না হওয়ায় বাইরে থেকে কারিগর এনে তারা কাজ করছেন এবং নতুন কোন অর্ডার নিচ্ছেন না।
কাজী নাসির উদ্দীন, সাতক্ষীরা