খুলনা জেলা প্রতিনিধি: আপনা মাংসে হরিন বৈরি। নিজের মাংসের জন্য হরিন নিজের শত্রু। প্রধানত সুস্বাদু মাংসের জন্য চলে হরিণ নিধন। অবস্থা এমন যে, সুন্দরবন এলাকায় হরিণের মাংষ ছাড়া প্রভাবশালীদের কোন ভোজ অনুষ্ঠান চলে না। ব্যবসার জন্য আসা বিদেশী অতিথি, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি, বিশেষ গন্যমান্য অতিথি এলে তাদেরকে হরিণের মাংস খাওয়ানো চাই-ই-চাই। আর শুধু মাংস বা কেন, হরিনের শিং ও চামড়ার রয়েছে প্রচুর চাহিদা। ফলে চলছে হরিণ নিধনযজ্ঞ। অথচ হরিণ সুন্দরবনের সবচেয়ে দৃষ্টি নন্দন প্রাণী। উজ্জল এবং প্রিয় দর্শন এই প্রাণি বাংলাদেশের সবার কাছে প্রিয়। সুন্দরবনের সর্বত্র এদের বসবাস। একসাথে চলাফেরা করে এবং যাওয়ার পথে পথে এর পায়ের চিহ্ন রেখে যায়। এই দৃষ্টি নন্দন প্রাণিকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। আজ হরিণ সুন্দরবন থেকে সুদুর পল্লীতে চলে এসেছে। দিনের পর দিন যে ভাবে হরিণ নিধন বেড়ে চলেছে তাতে করে আগামী দুই বছরের মধ্যে সুন্দরবন হরিণ শুন্য হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সুন্দরবনের মোট আয়তন ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৮৫ হেক্টর। এর ভেতর নদনদী ও খালবিল বাদে কেবল বনভূমির আয়তন ৪ লাখ ১ হাজার ৬শ’ হেক্টর। খুলনা, সাতক্ষীরা, চাঁদপাই ও শরণখোলা এই ৪টি রেঞ্জের সুন্দরবনের বন বিভাগের প্রশাসনিক কাঠামো এর অধীনে রয়েছে ১৬টি ষ্টেশন অফিস, ৩৯টি টইলফাড়ি, ৫৫টি কম্পার্টমেন্ট ও ২৩টি অস্থায়ী কুপ। এর আওতাধীন থানাগুলো হলো মংলা, বন মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা, দাকোপ, পাইকগাছা, কয়রা, শ্যামনগর, আশাশুনি। সুন্দরবন রেঞ্জ ও তানার আওতায় যে সমস্তএলাকায় নির্বিচারে হরিণ শিকার করা হয় সে গুলো হলো নীলকমল, কটকা, মেহেরআলি, অফিসকেল্লা, দুবলাচর, আলোরকোল, মাদারবাড়ীয়া, আঠারবেকী, দোবেকী, পুষ্পকাটি, বিবিরচর, চরমেঘনা, বুড়িগোয়ালিনী, কোদাবাক, কৈখালী ইত্যাদি। ব্যাপক অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ অঞ্চলের কোন উৎসবের সময় খাসির মাংসের পরিবর্তে হরিনের মাংস দেওয়া হয়। বিষয়টি এমন ওপেন সিক্রেট যে স্থানীয় প্রশাসন জানলেও এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহন করা হয় না। এ ব্যাপারে আলাপ হয় একজন স্কুল শিক্ষকের সাথে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই হরিণ শিকারের সাথে জড়িত। এলাকায় সৌখিন শিকারি হলেও এসব প্রভাবশালী ব্যক্তি ও স্থানীয় শিকারিদের সহায়তা নিতে হয়। তা না হলে তাদের কে বিভিন্ন ভাবে নাজেহাল করা হয়। সুন্দরবনে পিকনিক করার সময়ও চলে হরিণ নিধনের যঞ্জ। সারা বছর ধরেই সুন্দরবনে চলে হরিণ শিকারের মৌসুম। তবে শীত মৌসুমে হরিন শিকার বেশী চলে। আপনা মাংসে হরিণ বৈরি : হরিণের মাংস সুস্বাদু মাংস হিসাবে সকলের কাছে রয়েছে সমাদৃত। তাছাড়া সনাতন ধর্মাবলম্বীরা হরিণের মাংস পবিত্র এবং তা খেলে পাপ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় বলে মনে করেন। পেশাদার শিকারি বা যারা হরিণ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে তারা হরিণ শিকার করে লোকালয়ে নিয়ে আসে এবং চাহিদা অনুযায়ী মাংস, চামড়া, শিং বিক্রি করে। শুধু সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে হরিণের মাথা, শিং তৈরি লাঠি বিক্রয় করে বেশ কিছু পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের হরিণের শিং এর তৈরি লাঠি উপহার দেওয়া হয়। খুলনা, সাতক্ষীর, বাগেরহাট জেলায় ব্যাপক হারে ঘের হওয়ার ফলে সৃষ্ট গোলযোগ মীমাংসা করার জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে হরিণের মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় বলে জানা যায়।শিকারীর কথা : চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে শ্যামনগর উপজেলায় বসবাসকারি একজন শিকারির পরিবারের সঙ্গে আলাপ হলে, তিনি জানান তাদের পরিবারের একজন সদস্য দীর্ঘ ২০ বছর শিকারী জীবনে কতো হরিণ শিকার করেছে তার কোন হিসাব নেই।জানা যায়, প্রথম তিনি শখ করে হরিণ শিকার করতেন যে ভাবে চলে হরিণ শিকার : গৃহ পালিত পশুরমতো হরিণ গাছের পাতা বা সবুজ তৃন খেয়ে বেঁচে থাকে। উড়া, কেওড়া, গোল প্রভৃতি গাছের ফল তাদের প্রিয়। তার মধ্যে কেউড়া গাছের ফল ও পাতা অন্যতম। প্রথমে চোরা শিকারি বা শিকারিরা হরিণের আবাস্থলে গিয়ে নিশ্চিত হয়। তারপর কেওড়া গাছের উপর মাচান বা ঘর তৈরি করে বানরের মত ডাক শুরু করে। হরিণের দল তাদের ডাক শুনে কাছে এলে তারা গুলি করে। আবার বনের ভিতর উঠে আবাস স’লে যেয়ে টর্চেও আলো ফেলে হরিণকে আকৃষ্ট করে গুলি করে হত্যা করে। তারপর সুবিধা মত শিকারিরা ওই সমস- হরিণ লোকালয়ে নিয়ে আসে।হরিণ শিকারের অস্ত্র : বনরক্ষীদের সাথে থাকা রাইফেল ও গুলি সুন্দরবন এলাকায় লাইসেন্স করা বন্দুক এমনকি অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের বন্দুক ব্যাবহার করা হয় হরিণ শিকারের কাজেযেখানে চলে হরিণের মাংস বেচা কেনা : সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ, হরিহরনগর, ভেটখালি, পাইকগাছার গড়ুই খালি, কয়রা, আশাশুনির প্রতাপনগর, শরণখোলা, বাগেরহাট, মোড়েলগঞ্জ, পিরোজপুর মটবাড়িয়া এলাকায় অন্য মাংসের মত হরিনের মাংস বিক্রি করা হয়। হরিনের সরবরাহ না থাকলেও ৩শ’/৪শ’ টাকা কেজি দরে হরিণের মাংস পাওয়া যায়।হরিণের শিং ও লাঠি : সাতক্ষীরা জেলার প্রতাপনগর উইনিয়নে গড়ে উঠেছে হরিণের শিং দিয়ে বাহারী লাঠি তৈরি শিল্প। এই শিল্পে নিয়োজিত একদল শিল্পীর সাথে আলাপ হলে তারা জানায়, হরিনের শিং দিয়ে তৈরি একটি লাঠি বিক্রি হয় ১ হাজার থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত। হরিণের মাথা তৈরি করে তাতে হরিণের শিং লাগিয়ে বিক্রি করা হয় ২৫০০ টাকা পর্যন্ত। এ কাঁচা মাল কোথায় পান প্রশ্ন করলে তারা জানায়, আপনারা তো সব বোঝেন ঝামেলা করেন কেন ? প্রশাসন কোন ঝামেলা করে কিনা সে ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তারা বলেন, মাঝে মাঝে আমরা মাসোহারা দিয়ে চলি। চলছে নিধন প্রজনন বাড়ছে না : প্রতি বছর যে হারে হরিণ নিধন হচ্ছে সেহারে বংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এক সময় ছিলো যখন সমস- এলাকায় হরিণ পাওয়া যেত। কিন’ এখন কটকা, নীলকমল, মাদারবাড়িয়া এই ৩টি অভায়রাণ্য ছাড়া হরিণ তেমন একটা দেখা যায় না। এমতাবস্থায় সুন্দরবন ও হরিণ সম্পদ বাঁচাতে এখনই কঠোর ব্যবস’া নেয়া প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্ট সকল মহল থেকে দাবী জানানো হয়েছে।সম্পাদনা/শাবানা মন্ডল /০২.৫০ঘ /২১ ফেব্রয়ারি