সেই ২৮ ফেব্রুয়ারী গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ ট্রাজেডির বর্ষপুর্তি

গাইবান্ধা প্রতিনিধি:গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায়  ২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাজেডির প্রথম বর্ষপুতি । গত বছরের এই দিনে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হওয়ার পর এ উপজেলায় জামায়াত-শিবির ও সাঈদী ভক্তদের নারকীয় তান্ডবে পুলিশসহ ১০ জন নিহত হয়েছে । এ ঘটনায় প্রায় ৪৫টি মামলা দায়ের হয়েছে । এর মধ্য মামলার এজাহারে নাম উল্লেখ করা হয়েছে ১ হাজার ৫০৭ জনের ও অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে ৭৪ হাজার ১১৫ জনকে। তবে ৩৫৯ জনকে পুলিশসহ আইন শৃক্সখলা বাহিনী কর্মী সদস্যরা গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। এতে প্রায় ২ কোটি ৬৮ লক্ষ ২ হাজার ৭০০ টাকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়ে বলে জানা যায়। ইতো মধ্যে ক্ষতি গ্রস্থদের মাঝে ৫০ মেট্রিক টন চাল, ৫২ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা সরকারি ভাবে সহায়তা প্রদান করা হয়েছে ।

থানা পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্র্শী ও মামলা সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মানবতাবাদি সাঈদীর ফাঁসির রায় দেয়া হবে। এর প্রতিবাদে জামায়াত ইসলামী ওই দিন হরতালের ডাক দেয়। সকালে এ উপজেলার কঞ্চিবাড়ি, বেলকা, দহবন্দ, হরিপুর, বামনডাঙ্গা, সর্বানন্দ, তারাপুর, সোনারায়, রামজীবন ও ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেন জামায়াত ইসলামী ও সাঈদী ভক্তরা। দুপুরের পর ফাঁসির রায় ঘোষণা করার পর থেকেই বেপোরোয়া হয়ে ওঠে ওই সমর্থকরা। উপজেলার সড়কসহ বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয় গাছ কেটে রাস্তায় বেরিকেট সৃষ্টি, বন্ধ হয়ে যায় যোগাযোগ, সেই চলে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা। এক পর্যায়ে দুবৃর্ত্তরা উপজেলার ধুবনী-কঞ্চিবাড়ি বাজার, বেলকা বাজার, সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শহর, মীরগঞ্জ বাজার, ডোমেরহাট বাজার, বামনডাঙ্গা বাজার, বামনডাঙ্গা রেল স্টেশন ও শোভাগঞ্জ বাজার, বামনডাঙ্গা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র, ছাইতানতলা বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে দোকানপাট ভাংচুর করে এবং অগ্নিসংযোগ করেন। এছাড়াও উপড়ে ফেলে বামনডাঙ্গা রেল স্টেশনের রেল লাইন। সেই সঙ্গে বামনডাঙ্গা দলীয় অফিস, বেলকা কালিমন্দির, বামনডাঙ্গা কালিমন্দির, গংশারহাট ও পূজা মন্দির গুড়িয়ে দেয়। বামনডাঙ্গা রেল স্টেশনে পুলিশের সঙ্গে দুবৃর্ত্তরদের সাথে সংঘর্ষে নিহত হয় ৪ পুলিশ কনষ্টেবল। এরপর সুন্দরগঞ্জ থানা ঘেরাও করে ফেলেন ওই দুবৃত্তরা। থানার ভিতরে প্রবেশ করে ভাংচুরের চেষ্টা চালালে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এর কিছুক্ষণ পর গোটা উপজেলা জনশুন্য হয়ে পড়ে। পরদিন ১ মার্চ সকালে উপজেলার গংশার হাটে এক আ’লীগ সমর্থককে পিটিয়ে হত্যা করে দুর্বত্তরা। এদিকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতেই উপজেলা শহরে সমস্ত রাস্তাঘাটে গাছ ফেলে দিয়ে উপজেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এর ফাঁকেই জন্ম হয় সুন্দরগঞ্জ ট্রাজেডি। চলতে থাকে দিনের পর দিন হরতাল, অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ১৪ নভে¤^র এ উপজেলার ডোমেরহাটে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ্ মখদুম হলের ছাত্রলীগ সভাপতি এবং ২৮ নভেম্বর বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের ফলগাছা গ্রামের আ’লীগ নেতা আব্দুল হালিমকে পিটিয়ে হত্যা করে জামাত শিবির কর্মীরা। এরই একপর্যায়ে শুরু হয় দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনী হাওয়া। এ কারণেই গত ৫ জানুয়ারী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৪টি ভোট কেন্দ্রে ভোটের সামগ্রী পৌঁছাতে পারেননি প্রশাসন। এরপর স্থগিত ভোট কেন্দ্রে ভোট হয় ১৬ জানুয়ারি। ভোটে আ’লীগ প্রার্থী ও উপজেলা আ,লীগ সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন জয় লাভ করেন। এর পরপরই জামাত-শিবির কর্মীরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। একদিকে মামলার আসামী অপরদিকে আ,লীগ প্রার্থী এমপি। কি হবে তাদের ভবিষ্যৎ। এ কারণেই গত ১৯ জানুয়ারি পুলিশ আসামি ধরতে গেলে তারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এলাকাবাসির তোপের মুখে। এ সময় পুলিশ স্মরণকালের ১হাজার ১৬৬ রাউন্ড গুলি বিনিময় করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। মারা যান ১ শিবির কর্মি, আহত হন পুলিশসহ ৫৫ জন জামায়াত-শিবির কর্মি। এর আগেও ওইসব মামালার আসামি ধরতে গিয়ে তারাপুর ইউনিয়নের চর খোর্দ্দা, বেলকা ইউনিয়নের সর্দারের মোড়, দহবন্দ ইউনিয়নের ধুমাইটারী মোড়ে এবং রামজীবন ইউনিয়নের ডোমেরহাটে পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবির কর্মীর সংঘর্ষ এবং ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে পুলিশের কাছ থেকে খোয়া যায় গুলিসহ হ্যান্ডকাপ। সরকারি ভাবে যেসব ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রকাশ করা হয়েছে। বে-সরকারি ভাবে এর পরিমাণ তার চেয়েও দ্বিগুণ।

এ ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন তারা হচ্ছেন, বামনডাঙ্গা পুলিশ তদš— কেন্দ্রে কনস্টোবল হযরত আলী, নাজিম উদ্দিন, তোজাম্মেল হক, বাবলু মিয়া, আ,লীগ সমর্থক শরিফুল ইসলাম, ছাত্রলীগ নেতা এসএম খলিলুর রহমান মামুন, আ,লীগ নেতা আব্দুল হালিম, সত্যেন্দ্র চন্দ্র বর্মণ, শিবির কর্মী কাজী সোহানুর রহমান সোহাগ, শাহাবুল ইসলাম।

এছাড়াও ক্ষতি গ্রস্থ প্রতিষ্ঠান গুলো হচ্ছে মুসলিম দোকান ১৬২টি, হিন্দু দোকান-৬৬টি, মুসলিম বাড়ি-১২টি, হিন্দু বাড়ি-৬টি, মন্দির-৪টি, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান-২টি, আ,লীগ অফিস-৪টি, জাতীয়পার্টির অফিস-১টি, জাকের পার্টি -১টি, মুক্তিযোদ্ধা অফিস-২টি, গণউন্নয়ন অফিস-১টি, ইসলাম শিব বিল্ডাস্ অফিস-১টি, ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র-১টি, ক্লাব-২টি, বাস-১টি, রাইচ মিল-১টি, শিক্ষা সমিতি অফিস-১টি, প্রাথমিক বিদ্যালয়-১৭টি, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা-৬টি, ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার ৬৭টি।

এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাড়ায় ২৮ ফেব্রুয়ারী হতে ২মার্চ ২০১৩ সাল পর্যš— ইউনিয়ন ও পৌরসভা ওয়ারি শিক্ষা -প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় স্থাপনা, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, বে-সরকারি অফিস, বসতবাড়ির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ-১ কোটি ৯৪ লক্ষ ১৮ হাজার ৭০০ টাকা। নির্বাচন পূর্ব, নির্বাচন চলাকালিন এবং নির্বাচন পরবর্তী সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ-৩৩ লক্ষ ৪৫  হাজার এবং ব্যক্তি বা পরিবারবর্গের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ-৬৯ লক্ষ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা।

সরকারি ভাবে যাদের মাঝে অনুদান প্রদান করা হয়েছে তারা হচ্ছেন, নিতহ সত্যেন্দ্র চন্দ্র বর্মণ ১০ লক্ষ , এসএম খলিলুর রহমান মামুন ১০ লক্ষ, আব্দুল হালিম ১০ লক্ষ, শরিফুল ইসলাম ১০ লক্ষ, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজা বেগম কাকলি ৫ লক্ষ, আ’লীগ নেতা গোলাম মোস্তফা বাবুল ২ লক্ষ, ছাত্রলীগ নেতা শামিউল ইসলাম ছামু ২ লক্ষ, সন্তোষ কুমার বিকাশ ৭৫ হাজার, গণেশ চন্দ্র ২০ হাজার, ভবদিশ চন্দ্র ২০ হাজার, বিনয় চন্দ্র ২৫ হাজার, দেবেন চন্দ্র ২০ হাজার, নিলুফা ২০ হাজার, মন্দির ২০ মেট্রিক টন চল, মুক্তিযোদ্ধার অফিস ১০ মেট্রিক টন চাল, ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারবর্গের বিপরীতে ২০ মেট্রিক টন চাল ও ২ লক্ষ টাকা।

এ বিষয় নিয়ে কথা হয় উপজেলা আলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা আহমেদের সাথে তিনি বলেন-বর্তমান সুন্দরগঞ্জ উপজেলার এ পরিস্থিতির মুল কারণ হচ্ছে- প্রশাসনের সাথে জনগণ ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কাক্সিখত যোগাযোগের অভাব।

সুন্দরগঞ্জ থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোজাম্মেল হক জানান, সরকারি বিধি মোতাবেক এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমরা আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে সর্বদাই সচেষ্ট। অন্যায়কারিকে আমরা কখনও সায় দেই নাই আর দিবও না।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু রাফা মোহাম্মদ আরিফ বলেন, সরকারি নির্দেশ মোতাবেক আমার অবস্থান থেকে আমি সুন্দরগঞ্জ উপজেলাকে সুন্দর রাখতে চাই। এজন্য আমি দলমত নির্বিশেষে সকলের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করছি। এ আসনের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন জানান-সুন্দরগঞ্জ উপজেলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে অত্যন্ত ভাল। সাধারণ জনগণের মাঝে আর তেমন আতঙ্ক নেই বললেই চলে।

 

Exit mobile version