রাতে ‘কাস্টমার’, দিনেই পুজা দেখেন পার্বতী-চাঁপারা

অনলাইন ডেস্কঃ- পিতৃপক্ষের শেষ হয়নি তখনও৷ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্বর্গীয় গলায় অকালেই আগমনির সুর৷ মঞ্চে একঝাঁক রংচঙে মুখের নিপুণ মহিষাসুরমর্দিনী অভিনয়৷ মন্ত্রমুগ্ধ জনতা৷ হাততালির ফোয়ারা৷

দৃশ্য ২: বাস্তবের রাজপথ৷ বড় রাস্তার ধারে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে থাকা কতগুলো মেয়ে৷ ওঁরা মঞ্চে মহিষাসুর বধ করতে পারলেও বাস্তব জীবনে পারেনি৷ তাই ওঁদের ঠিকানা কেয়ার অফ যৌনপল্লি৷ শরতের মেঘ ভেসে বেড়ায় ওঁদের ঘিঞ্জি গলির আকাশেও৷ কিন্তু, শিউলির আঘ্রাণ, কাশের বনের ঠান্ডা হাওয়া, নতুন জামার পাটভাঙা গন্ধ— আগমনির সুরের সঙ্গে সে সব কি এসে কড়া নাড়ে যৌনপল্লির ঘরগুলোয়?

কথা হচ্ছিল পার্বতীর সঙ্গে জন্ম ভারতের বহরমপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে হলেও গত তিনদশক তাঁর ঠিকানা সোনাগাছি৷ পুজার কথা উঠতেই চল্লিশ পেরোনো মধ্যবয়স্কার মুখে আঁধার নেমে এল৷ ‘আমাদের গ্রামের ধারে বিশাল একটা এলাকা জুড়ে কাশবন ছিল৷ পুজা আসছে, সেটা ওই কাশবন দেখেই বুঝে যেতাম৷ পাশের গ্রাম থেকে ঢাকিরা কলকাতায় আসত পুজায়৷ যেদিন ওঁরা বের হত, সেদিন বহুদূর দৌড়ে যেতাম ঢাকের আওয়াজ শুনতে’, ফিকে হয়ে আসা পুজার স্মৃতি হাতড়ে বলেন পার্বতী৷ তেরোর কোঠা পেরোনোর আগেই কলকাতায় পাচার হয়ে গিয়েছিল সেদিনের ফর্সা টুকটুকে পার্বতী৷ পেটের দায়ে নিজের বাবাই বিক্রি করে দিয়েছিল অন্যের হাতে৷ কৈলাস যাত্রা হয়নি৷ এ হাত সে হাত ঘুরে পার্বতীর ঠিকানা হয় সোনাগাছি৷ তারপর থেকে পুজা মানেই– ‘রাতভর কাস্টমারের ভিড়৷ দিনে শরীর চলে না আর,’ উদাস গলায় বলেন তিনি৷
গৌরির বাপের বাড়ি ফেরা নিয়ে এত উদ্দীপনার মানে অবশ্য বোঝেন না চাঁপা৷ বুঝবেনই বা কি করে? তাঁর বাপের বাড়ি-শ্বশুরবাড়ি দুটোই যে সোনাগাছি৷ পার্বতীর মতো অন্য পুজা সে দেখেইনি৷ তবু, দুর্গাঠাকুরের মুখ তো দেখেছেন? প্রশ্ন শুনে হেসে গড়িয়ে পড়েন চাঁপা৷ বলেন, ‘ওমা ঠাকুর দেখব না কেন? এখানকার বান্ধবীরা মিলে বেলায় বেলায় ঠাকুর দেখতে যাই তো! তবে রাতটা বেরোনো হয় না৷ বোঝেনই তো৷ মা দুগ্গা বাপের বাড়ি এসেছে বলে আমাদের এখানে কাস্টমারদের আসার হুজুগটাও তো বেড়ে যায়, তাই৷’

তবে, ফি বছর ষষ্ঠী আর অষ্টমীর উপোস করতে ভোলেন না চাঁপা৷ দুর্বারের উদ্যোগে বাইরে পড়াশুনা করতে যাওয়া ছেলেমেয়েরা বাড়ি ফেরে৷ তাদের মঙ্গলকামনার জন্যই৷

পার্বতী-চাঁপারা নিজেদের জীবনের অনেকটা সময় পুজার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন৷ মানিয়েও নিয়েছেন৷ কিন্তু, হাল আমলে যৌনব্যবসায় আসা পরী, খুশবুরা সব বাধার মধ্যেও আনন্দ খুঁজে নেওয়ারচেষ্টা করেন৷ বলেন, ‘নিজের ইচ্ছায় হোক বা বাধ্য হয়ে, যৌনপল্লিতে যখন এসে পৌঁছেছি, তখন বাঁচাবন্ধ করব কেন? আমরাও অন্যদের মতো পুজাতে নতুন জামা কিনি৷ ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে আইসক্রিম, রোল কিনে খাই৷ সন্ধ্যায় খুব ঘুরতে পারি না বটে৷ কিন্তু, কলকাতায় তখন চারপাশে কত কত আলো, তা দেখলেই মনভরে যায়৷’

গত দু’বছর দুর্বার মহিলাসমন্বয় সমিতির উদ্যোগেপুজা শুরু হয়েছে সোনাগাছির অন্দরে৷

নিজের সব গ্লানি ভুলে যৌনকর্মীরা হাতে হাত মিলিয়ে দুর্গতিনাশিনীর বন্দনায় মেতে ওঠেন৷

অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধিপুজা, সবই তাঁরা করেছেন রীতি মেনে৷ পুজার ক’টা দিন জীবনের সব অন্ধকার দিক, দুঃখের কথা ভুলেপুজার আনন্দ ভাগ করে নেন৷ কিন্তু, এ রাজ্যে যৌনপল্লীর সংখ্যা তো নেহাত কম নয়! তাঁরা সবাই তো পুজার আনন্দ ভাগ করে নেওয়া সুযোগ পান না৷

তাঁদের জন্য? তাঁদের পুজায় এখনও বোধনের রং লাগা বাকি৷ হয়তো ভবিষ্যতে উত্সবের আলো জ্বলবে তাঁদের অন্ধগলিতেও৷ খবরঃএই সময়

Exit mobile version