অনলাইন ডেস্কঃ- চোখ মেলে পৃথিবীর আলো দেখলো নতুন এক শিশু৷ কিন্তু বাবা, মা, পরিবার – কেউ খুশি নয়৷ জন্মের পরপরই হত্যা করা হলো শিশুটিকে, ছুড়ে ফেলা হলো আস্তাকুড়ে এভাবে প্রতি বছর শত শত ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ অথবা আইনের দৃষ্টিতে ‘অবৈধ’ সন্তানকে গোপনে হত্যা করা হচ্ছে পাকিস্তানে৷ দক্ষিণ এশিয়ার এই ইসলামিক প্রজাতন্ত্রে বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক এবং গর্ভপাত নিষিদ্ধ৷ ফলে যখনই কোনো অবিবাহিত তরুণী গর্ভধারণ করে, তার পরিবারকে গ্রাস করে আতঙ্ক৷ শেষ পর্যন্ত এর ফয়সালা হয় কোনো একটি ক্লিনিকে৷ নিজের পেটে ধরা সন্তানকে হয়ত নিজের হাতেই মৃত্যুর পথে ঠেলে দেন অশ্রুসিক্ত সেই কিশোরী মা৷গুজরানওয়ালা শহরের এক মাতৃসদনের নার্স রাজিয়া জুলফিকার জানান, পাকিস্তানের ক্লিনিকগুলোতে প্রতিদিনই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে৷ ‘কয়েকদিন আগে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা একটি মেয়ে আমাদের ক্লিনিকে আসে৷ আমরা তাকে ভর্তি করতে চাইনি৷ কিন্তু তার পরিবার বার বার অনুরোধ করায় শেষ পর্যন্ত রাজি হই৷ তবে তাদের সাফ জানিয়ে দেই, বাচ্চাটাকে আমরা মারতে পারব না৷” রাজিয়া জুলফিকার ডয়চে ভেলেকে জানান, জন্মের পর শিশুটিকে তারা ওই পরিবারের হাতে তুলে দেন৷ কেবল তারাই জানে, সেই নবজাতকের ভাগ্যে কি ঘটেছে, কীভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে৷ নিষেধ ভেঙে প্রেম-প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশ পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্ক পুরোপুরি নিষিদ্ধ৷ ইসলামি শরিয়া আইনেও ব্যাভিচার একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ফলে কোনো অবিবাহিত মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা আইন তুলে নেন নিজেদের হাতে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে মা আর তার সন্তানকে খুন হতে হয়৷রাজিয়া জুলফিকার বলেন, কড়া বিধিনিষেধের পরও পাকিস্তানে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়াচ্ছে মানুষ, বিয়ের আগেই যাচ্ছে শারীরিক সম্পর্কে৷ ‘‘আমরা এমন এক সমাজে বাস করি, যেখানে আমাদের ছেলে-মেয়েদের হাতে মোবাইল ফোন আছে, তারা পশ্চিমা সিনেমা দেখছে৷ কখনো কখনো তারা সমাজের নিষেধ না মেনে প্রেমে জড়াচ্ছে, যা খুশি তাই করছে৷ কিন্তু পরিবার যখন বিষয়টি জানতে পারছে, ততদিনে হয়ত মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়েছে৷অপরাধ ও শাস্তি-বেসরকারি সংস্থা এধি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর পাকিস্তানের বড় শহরগুলোতেই অন্তত ১ হাজার ১০০ শিশুকে জন্মের পরপরই হত্যা করে আস্তাকুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে৷ সারা দেশের তথ্য পাওয়া গেলে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে৷এধি ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপক আনোয়ার কাজমি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কিছুদিন আগে ছয় দিনের একটি শিশুকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে৷ গলায় ফাঁস পরানো অথবা কোনো জানোয়ার কিছু অংশ খেয়ে ফেলেছে – এমন লাশও আমরা পেয়েছি৷” তিনি জানান, একটি ঘটনার কথা তিনি কখনোই ভুলতে পারবেন না৷ এক নারী তাঁর নবজাতক সন্তানকে এক মসজিদের সামনে রেখে এসেছিলেন৷ তিনি হয়ত আশা করেছিলেন, কেউ তাঁর সন্তানকে দেখে দয়াপরবশ হয়ে বাড়ি নিয়ে যাবে, তাকে বড় করে তুলবে৷ ‘‘কিন্তু মসজিদের ইমাম বাচ্চাটাকে পাথর ছুড়ে মারতে বললেন৷ শিশুটির ছিন্নভিন্ন সেই দেহ আমি নিজে চোখে দেখেছি৷”দোলনা- ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ এই শিশুদের হত্যা না করতে উৎসাহ দিতে ‘ঝোলা’ নামে অনন্য এক প্রকল্প চালু করেছে এধি ফাউন্ডেশন৷ বাংলায় ‘ঝোলা’ শব্দের মানে হলো দোলনা৷ একজন মা তাঁর ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ শিশুটিকে হত্যা করার বদলে এধির দোলনায় রেখে যেতে পারেন এবং এ জন্য তাঁর পরিচয়ও প্রকাশ করতে হয় না৷ আনোয়ার কাজমি জানান, পাকিস্তানে তাদের তিনশরও বেশি ‘দোলনা কেন্দ্র’ আছে, যেখানে এই শিশুদের রেখে যেতে পারেন তাদের বাবা-মায়েরা৷ এখানে আসতে তাঁদের ভয়ের কিছুই নেই, তারপরও সমাজের কথা ভেবে মানুষ অনেক সময় উৎসাহী হয় না৷ পাকিস্তানে গর্ভপাত নিষিদ্ধ হওয়ায় নবজাতক হত্যার সংখ্যাও বাড়ছে৷ কোনো বিবাহিত নারীর প্রাণ সংশয় তৈরি হলে কেবল তখনই তাকে গর্ভপাতের অনুমতি দেয়া হয়৷ তা না হলে কোনো অবস্থাতেই পাকিস্তানে ভ্রুণ হত্যার অনুমতি দেয়া হয় না৷ অন্যদিকে নবজাতক হত্যাও আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ, খবর- ডি ডাব্লিউ এর, যদিও পাকিস্তানে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ শিশুদের মেরে ফেলা অতটা গুরুতর অপরাধ বলে মনে করা হয় না৷