অপূর্ব লাল সরকার, আগৈলঝাড়া (বরিশাল) থেকেঃভেগাই হালদারের জন্ম না হলে আগৈলঝাড়া সৃষ্টি হতনা। সকল বৈরীতাকে জয় করে মানব মনের সুকুমার বৃত্তিসমূহকে কুসুমিত করার মহতী প্রয়াসে ৯৪বছর পূর্বে ১৯১৯ সনের ২৬ জানুয়ারি এ জনপদে শিক্ষার পরশমণি ছোঁয়াতে যিনি ব্রতী হয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন, পুণ্যশোক মহাত্মা ভেগাই হালদার । তাঁর অমর কীর্তি আগৈলঝাড়া ভেগাই হালদার পাবলিক একাডেমীর ৯৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। আলোচনা সভায় বক্তারা উপরোক্ত বক্তব্য রাখেন।
বিদ্যালয় সম্পর্কিত কিছু কথা- পুণ্যশোক মহাত্মা ভেগাই হালদারের স্মৃতিবিজড়িত কর্মক্ষেত্রে আগৈলঝাড়া। পুণ্যভূমি বরিশাল জেলার উত্তর-পশ্চিমপ্রান্তে প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলে অবস্থিত আগৈলঝাড়া একটি গ্রাম নয়, এটি প্রখ্যাত মানসী ফুলশ্রী গ্রামে দক্ষিণ-পশ্চিমপ্রাপ্রান্তের কিছু অংশ মাত্র। যথার্থই কবির কন্ঠে ধ্বণিত হয়েছে ‘পশ্চিমে ঘাঘর নদী পূর্বে ঘন্টেশ্বর, মাঝখানে ফুলশ্রী গ্রাম পন্ডিত নগর।’ এ পবিত্র ভূমিতেই বাংলার সাহিত্যের অমর কীর্তি মনসামঙ্গল কাব্য প্রণেতা কবিবর বিজয়গুপ্ত জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তার অমর কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। মানসী ফুল্লশ্রী সেই থেকে পন্ডিতনগর নামে আখ্যায়িত হয়ে আসছে। এখানকার ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থ স¤প্রদায়ের অধিবাসীরাই ছিলেন এতদাঞ্চলের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত। মানসী ফুল্লশ্রী ও গৈলা গ্রামের পশ্চাৎভূমিতে চতুর্দিকে বহুদূর বিস্তৃত অনেক গ্রামের নিরন্ন কৃষকগণ ছিলেন প্রদীপের নিম্নভাগে অন্ধকারের মত। গৈলা-ফুলশ্রীর প্রধানরা ছিলেন এতদাঞ্চলের জমিদার ও তালুকদার। তাদেরই প্রজা ছিল সব কৃষক, জেলে, কামার-কুমাররা। তারা প্রজাসাধারণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের কোন প্রচেষ্টা কখনও করেননি, বরং জাত-পাত আর বর্ণবৈষম্যের শিকারে পরিণত করেছিলেন ওইসব নিম্নশ্রেণীর সহজ সরল মানুষদের। উল্লেখ্য, ফুলশ্রী গ্রামের ঐতিহ্যের প্রভাবে দক্ষিণপাশে অবস্থিত সুজনকাঠি গ্রামটিও ফুল্লশ্রী নামে গণ্য হয়। এই সুন্দর বিশ্বে ভেদ-বৈষম্যের কদর্যতা দূরীকরণার্থে সেই ঐতিহাসিক ক্ষণে সুজনকাঠী বা ফুল্লশ্রী গ্রামে ১২৬০ বঙ্গাব্দের ২১ আষাঢ় সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সাধু জগন্নাথের ঔরসে সাধ্বী শ্যামতারার কোল আলো করে আবির্ভূত হ’ন মহাত্মা ভেগাই। এ জনপদের পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠীকে সা¤প্রদায়িকতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করে বিশ্বৈকতাবাদে উত্তোরণের জন্য ১৯১৯ সালের ২৬ জানুয়ারি এক পুণ্যলগ্নে এতদাঞ্চলের শ্রদ্ধাষ্পদ দুই মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত এবং কৈলাশ চন্দ্র সেনসহ কতিপয় পুণ্যবানদের সৎ পরামর্শে মহাত্মা ভেগাই হালদার প্রতিষ্ঠা করেন আগৈলঝাড়া মিডল ইংরেজী স্কুল। মহাত্মা ভেগাই হালদার মহাশয়ের প্রতিষ্ঠিত উক্ত বিদ্যালয়ের সংস্কারপূর্বক অনুন্নত সম্প্রদায়ের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তুলতে তৎকালীন এমএলএ মহাপ্রাণ যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলের ঐকান্তিক প্রয়াসে মিডল ইংরেজী স্কুলটি ১৯৩৮ সালে উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। তৎকালীন বণবৈষম্যের ধারক সমাজপতিদের ষড়যন্ত্রে বিদ্যালয়টির বাতিল হওয়া মঞ্জুরী সমস্যার ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের সম্পাদক, নমঃশুদ্র স¤প্রদায়ের অবিসংবাদিত নেতা তৎকালীন এমএলএ মহাপ্রাণ যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলের উদ্যোগে তৎকালীন বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী কৃষক-শ্রমিক নেতা শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের বিশেষ সহযোগিতায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে স্থায়ী মঞ্জুরী লাভ হয়। মহাত্মা ভেগাই হালদারের প্রতি এতদাঞ্চলের বঞ্চিত জনতার পরম শ্রদ্ধার নিদর্শণ স্বরূপ তাঁর লোকান্তরে অত্র বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয়ওআগৈলঝাড়া ভেগাই হালদার পাবলিক একাডেমী।
৯৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দুদিনব্যাপী ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ ও আলোচনা সভায় প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অবণী ভূষণ হালদারের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আবুল কালাম তালুকদার। বক্তব্য রাখেন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মো. জসীম সরদার, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবুল হোসেন, ডেপুটি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আ. রইচ সেরনিয়াবাত, ড. নীলকান্ত বেপারী, বালিকা বিদ্যালয় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নির্মলেন্দু বাড়ৈ, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক যতীন্দ্র নাথ মিস্ত্রী, ম্যানেজিং কমিটির সদস্য, শিক্ষার্থী অভিভাবকসহ উপজেলার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নেতৃবৃন্দ।