জি নিউজ বিডি ডট নেটঃ- আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কলঙ্কময় দিন। ২০০৯ সালে এই দিনে রাজধানীর পিলখানায় তৎকালিন বিডিআর সদর দফতরে ঘটে যায় এক মর্মান্তিক নৃশংস ঘটনা। ৩৬ ঘণ্টার এ হত্যাযজ্ঞে সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকস অফিসারকে হত্যা করা হয়। যাদের মধ্যে বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) তৎকালীন ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদও ছিলেন। ডিজির স্ত্রীসহ সামরিক-বেসামরিক আরো ১৭ জনকে হত্যা করা হয় ওইদিন। ঘৃণ্যতম ওই ঘটনায় মোট নিহত হন ৭৪ জন। যা ঘটেছিল সেদিন : ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকর্তা ও জওয়ানেরা বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সপ্তাহ উপলক্ষে এসেছিলেন ঢাকার পিলখানায়। আগের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিলখানায় বিডিআর সপ্তাহ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত কুচকাওয়াজে অংশ নেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত সদস্যদের মধ্যে ভালো কাজের জন্য পদক প্রদানের কথা ছিল। দরবার হলের সেই অনুষ্ঠানে প্রায় আড়াই হাজার বিডিআর সদস্য উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত শেষে বাংলা অনুবাদ যখন শেষ হয় ঠিক তখনই সিপাহি মইন দরবার হলের রান্নাঘরের পাশ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে মেজর জেনারেল শাকিলের দিকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। অতিরিক্ত ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারিসহ অন্যান্য কর্মকর্তা মইনকে আটক করেন। মইনকে আটকের সাথে সাথে ‘জাগো’ বলে বিডিআর জওয়ানেরা দরবার হল ত্যাগ শুরু করে। ডিজি তখন তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, তাদের দাবি দাওয়া শুনবেন তিনি। কিন্তু মুহূর্তেই দরবার হল শূন্য হয়ে যায়। একপর্যায়ে জওয়ানদের সবাই যখন দরবার হল ত্যাগ করে তখন বাইরে থেকে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু হয়। কর্মকর্তারা বিভিন্নভাবে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। তাদের খুঁজে খুঁেজ বের করে জওয়ানেরা হত্যা করে। বিডিআর ঢাকা সেক্টরের তৎকালীন কমান্ডার কর্নেল মজিবুল হককে ৩৬ রাইফেল ব্যাটালিয়নের চারতলার একটি কক্ষে হত্যা করে তার লাশ ফেলে দেয়া হয় নিচে। এভাবে একে একে হত্যা করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের। লুটপাট অগ্নিসংযোগসহ নানা অপকর্মে মেতে ওঠে বিডিআর জওয়ানেরা। এসবই করেছে অস্ত্রাগার থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করে। শুরুতেই তারা কোত ভেঙে অস্ত্র এবং ম্যাগাজিন ভেঙে গুলি তাদের হেফাজতে নিয়ে নেয়। ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। আতঙ্কে আশপাশের কয়েক কিলোমিটারের বাসিন্দারা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেন।এদিকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনসহ অনেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সামরিক-বেসমারিক বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্তারা ঘটনাস্থলে যান। কিন্তু তারা ছিলেন পুরোপুরি অসহায়। বিদ্রোহীদের তাণ্ডবে প্রাণের ভয়ে পিলখানার আশপাশেও কেউ যেতে পারেননি। বিকেলে দূর থেকে হ্যান্ডমাইকে বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেন এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। মাইকে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করবেন। তিনি সবাইকে অস্ত্র সমর্পণ করতে বলেন। সন্ধ্যার দিকে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বিডিআরের ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবনে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক শেষে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা ও তাদের দাবি-দাওয়া পূরণের আশ্বাস নিয়ে তারা পিলখানায় ফিরে যান। এরপরও তারা অস্ত্র সমর্পণ ও বন্দীদের মুক্তি দেয়নি। মধ্যরাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সাথে বৈঠক করে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ শুরু করে। কিন্তু পর দিনও থেমে থেমে গুলির শব্দ আসতে থাকে। ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানা থেকে আবিষ্কৃত হয় গণকবর। গণকবর থেকে উদ্ধার করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের লাশ। তাদের অবুঝ শিশু, সন্তান অথবা তাদের স্ত্রীরা হারিয়ে ফেলেন স্বাভাবিক জীবনের চলফেরার মুহূর্ত। লাশ আর পিলখানার ধ্বংসযজ্ঞ দেখে সারাদেশের মানুষ হতবাক হয়ে যায়। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেন, পরিস্থিতি শান্ত, সবাই অস্ত্র সমর্পণ করেছে। বিডিআর বিদ্রোহের বিচার হয়েছে। বিচার হয়েছে ওই দিনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের। কিন্তু মানুষ সেই দিনের নির্মমতা ভুলতে পারছেন না। সেই বীভৎস দৃশ্য চোখে ভেসে উঠতেই আঁতকে ওঠেন মানুষ। এখনো বাতাসে ভাসছে স্বজনহারাদের কান্না। শুধু হত্যা করেই নরপশুরা খ্যান্ত হয়নি। অফিসারদের স্ত্রী-সন্তান এবং বাবা-মাকে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালায় তারা। তাদের বাড়ি-গাড়ি, আসবাবপত্র এবং অন্যান্য সম্পদ আগুনে পুড়ে ফেলে উচ্ছৃঙ্খল বিপথগামী জওয়ানেরা। সেনা কর্মকর্তাদের শুধু হত্যা করেই খ্যান্ত হয়নি ঘাতকেরা। আলামত নষ্ট করতে প্রথমে তাদের লাশগুলো পুড়ে ফেলার চেষ্টা করে তারা। ব্যর্থ হয়ে লাশগুলো মাটিচাপা এবং ম্যানহোলের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়।উল্লেখ- উচ্ছৃঙ্খল জওয়ানেরা অস্ত্রাগার লুট করে তাই দিয়ে সেনা অফিসারদের হত্যা করে। নির্মম ওই হত্যাকাণ্ডের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত হচ্ছে আজ। নৃশংস এই ঘটনার পর বিডিআর আইনে মোট ৫৭টি মামলা হয়। এই মামলার বিদ্রোহের রায় শেষ হয়েছে। অভিযুক্তদের অনেকে ইতোমধ্যে সাজা ভোগ করে বের হয়ে গেছে। নিম্ন আদালতে হত্যাকাণ্ডেরও বিচার সম্পন্ন হয়েছে গত বছরের ৫ নভেম্বর। রক্তাক্ত বিদ্রোহের পর সীমান্ত রা বাহিনীর নাম বদলে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বদল করা হয় তাদের পোশাক। হত্যার বিচার, বিদ্রোহের বিচার সবই হয়েছে। কিন্তু সেই ঘৃণ্য পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের কাহিনী কেউ ভুলতে পারছে না। এখনো মানুষ আঁতকে ওঠেন সেই নৃশংস ঘটনার কথা মনে করে। যারা স্বজন হারিয়েছেন তাদের আর্তনাদ এখনো থামেনি। আজ সেই বীভৎস হত্যকাণ্ডের দিন। এছাড়া এ দিবসটিতে সকাল ৯ টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রতিনিধি এ পুস্তস্তবক অর্পণ করবেন। এছাড়া স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, বিজিবি মহাপরিচালক সেনা কর্মকর্তাদের কবরস্থানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।তাঃ-২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।