জি নিউজ ডেস্কঃ- শিশু অধিকার, বাংলাদেশের আইন ও সাধারণ মানুষের মনোভাব কি শিশুবান্ধব? একদিকে শিশুরা যেমন হত্যা-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে নানা ‘অপরাধের’ কথা বলে তাদের আটক করা হচ্ছে সাধারণ আইনে৷ তার ওপর সংশোধন কেন্দ্রগুলোও শিশুদের উপযোগী নয়!
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রণীত শিশু আইন অনুযায়ী, এখন ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত যে কেউ শিশু হিসেবে বিবেচিত হবে৷ শুধু তাই নয়, নয় বছরের কম বয়সি শিশুকে কোনো অপরাধের অভিযোগে আটক বা শাস্তি দেয়া যাবে না৷ ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কাউকে আটক করা হলে তাদের হ্যান্ডকাপ পড়ানো যাবে না৷ আর শিশু-কিশোরদের বিচার হতে হবে শিশু-কিশোর আদালতে৷ আদালত তাদের বিচার শেষে ‘অপরাধের’ প্রমাণ পেলে শিশু কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হবে অভিযুক্তদের৷ আদালত যতদিন নির্দেশ দেবে, ততদিন তারা সেখানে থাকবে৷ বলা বাহুল্য, এই সব কেন্দ্রে শিশুদের মানসিক, চারিত্রিক, শিক্ষা এবং আত্মিক উন্নয়ন ঘটানোর কথা৷ কিন্তু বাস্তবে কী হয় তা কয়েকটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে৷
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে গাজীপুরের টঙ্গীতে শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ২০ জন শিশু-কিশোর তাদের নির্যাতন এবং ঠিকমত খাবার না দেয়ার ‘রক্তাক্ত প্রতিবাদ’ জানায়৷ তারা ধারালো ব্লেড দিয়ে তাদের হাতসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে প্রতিবাদ জানালে এবং তা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে, ব্যাপক আলোচনায় আসে৷ কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, পরে সমাজসেবা অধিদপ্তর তদন্ত করে ঐ শিশু-কিশোরদেরই দায়ী করে৷ এমনকি তাদের ‘বেয়াড়া’ বলে তদন্ত প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়৷
এরপরে যশোরে শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রেও প্রতিবাদের ঘটনা ঘটে৷ একই বছরের মে মাসে মারপিট, নিম্নমানের খাবার সরবরাহসহ সাতটি অভিযোগকে নিয়ে কিশোররা ‘বিদ্রোহ’ করলে পুলিশ তাদের নিবৃত্ত করতে গুলি ছোঁড়ে৷ পুলিশি ধাওয়া ও গুলিতে আহত হয় ১৩ কিশোর৷ পরে নির্যাতনের মুখে ১৬ জন শিশু-কিশোর পালিয়ে যায়৷ এ সব কেন্দ্রে নয় বছরের কম বয়সি শিশুদের রাখা হয় বলে ঘটনার পর তদন্তে বেরিয়ে আসে, যা বেআইনি৷
আরেকটি উদাহরণ দিলে শিশুদের ব্যাপারে আইন লঙ্ঘনের বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে৷ চলতি মাসেই হবিগঞ্জে এক স্কুলছাত্রীকে মারধরের ঘটনায় আটক চঞ্চল রহমানের (১৪, ছদ্মনাম) সাত দিনের রিমান্ড আবেদন জানায় পুলিশ৷ তাকে হ্যান্ডকাফ পড়ানো হয়৷ এমনকি তার ছবি সংবাদমাধ্যমেও দেয়া হয়৷ আদালত অবশ্য তাকে শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়৷
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব মতে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর কমপক্ষে দুই হাজার শিশুকে নানা ‘অপরাধে’ আটক করা হচ্ছে৷ দুঃখের বিষয়, তাদের সঙ্গে পুলিশ প্রাপ্তবয়স্ক আসামির মতোই আচরণ করে৷ শিশু অধিকার ফোরাম নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২৭৬ জন শিশুকে আটকের কথা বলা হয়েছে৷ তাদের অস্ত্র ও মাদক বহনসহ নানা অভিযোগে আটক করা হয়৷ এই হিসাব সংবাদমাধ্যম থেকে নিয়েছে সংস্থাটি৷ তাই যা সংবাদমাধ্যমে আসেনি তার হিসাব তারা দেয়নি৷
তবে তাদের হিসাবে শিশুদের রাজনৈতিক দল এবং অপরাধী চক্রের বিশেষ করে অবৈধ মাদক এবং অস্ত্র ব্যবসায়ীদের ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষণীয়৷ বর্তমান আইনে শিশুদের যারা ব্যবহার করে, তাদের শাস্তির কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু বাস্তবে শিশুদের অবৈধকাজে ব্যবহারকারীরা শাস্তির আওয়তায় আনা যায় না৷ শিশুদেরই শাস্তি পেতে হয়৷
আটক শিশুদের বড় একটি অংশকে শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয় না৷ পুলিশ বয়স বাড়িয়ে দিয়ে (১৮ বছরের বেশি দেখায়) তাদের সাধারণ আইনেই বিচারে সোপর্দ করে৷ এরপর তাদের পাঠানো হয় কারাগারে৷ কিন্তু আইনে আছে শিশু-কিশোরদের কোনোভাবেই সাধারণ আইনের আওতায় আনা যাবে না৷ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ শিশু আইনে শিশু-কিশোর আদালতে নিষ্পত্তি করতে হবে৷ আর প্রত্যেক জেলা এবং মেট্রোপলিটন এলাকায় শিশু আদালত গঠনের কথা বলা আছে আইনে৷
বাংলাদেশের গাজীপুরে দু’টি এবং যশোরে একটি শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে৷ এর মধ্যে গাজীপুরের একটি মেয়েদের জন্য৷ সব মিলিয়ে এই তিনটির ধারণ ক্ষমতা ৬০০ জনের৷ তাহলে বোঝা যায় আটক শিশুদের বড় একটি অংশ কারাগারেই থাকে, উন্নয়ন কেন্দ্রে জায়গা হয় না৷ উন্নয়ন কেন্দ্রে পুলিশ, সমাজসেবা অধিদপ্তর এবং অভিভাবকরা শিশুদের পাঠায়৷
গত বছর গাজীপুর ও যশোরের শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ‘বিদ্রোহের’ পর তার প্রেক্ষাপট নিয়ে গবেষণা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান৷ তিনি দু’টি কেন্দ্রই পরিদর্শন করেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানান, ‘‘এই উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর আগে নাম ছিল সংশোধন কেন্দ্র৷ নামের পরিবর্তন হলেও পরিবেশ বা ব্যবস্থাপনার কোনো উন্নয়ন ঘটেনি৷ শিশু-কিশোরদের পর্যাপ্ত খাবার, প্রয়োজনীয় পোশাক এবং শিক্ষা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয় না৷ ফলে তাদের উন্নয়ন বা সংশোধন না হয়ে তারা বরং ‘অপরাধী’ হয়ে উঠতে পারে৷”
তিনি বলেন, ‘‘দেশে বর্তমান শিশু আইনটি যথেষ্ট ভালো হলেও এর প্রয়োগ তেমন নেই৷ অনেক শিশুকেই বড়দের সাথে কারাগারে রাখা হয়৷ আবার নয় বছরের নীচের শিশুকেও আটক করা হয়৷”
তিনি তাঁর গবেষণার আলোকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে শিশুরা প্রধানত অপরাধে জড়িয়ে পড়ে অপরাধী চক্রের কারণে৷ তারা শিশুদের ব্যবহার করে৷ এছাড়া পারিবারিক এবং সামাজিক অবস্থার কারণেও তারা অপরাধে জড়ায় না জেনে৷ বাংলাদেশের শিশুদের একটি অংশ শেকড়হীন, পথ শিশু, তারাই অপরাধী চক্রের প্রধান টার্গেট৷”
শেখ হাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘‘শিশুদের জন্য নতুন করে ভাবতে হবে৷ উন্নয়ন কেন্দ্র বা জেলখানা নয়, তাদের সত্যিকার অর্থেই পারিবারিক পরিবেশে সংশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে৷”
শিশুদের অপরাধের নামে আটকের পাশাপাশি তারা নানাভাবে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে শিশুরা৷ শিশু অধিকার ফোরামের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২,৮০১ জন শিশু হত্যাসহ নানা ধরণের নির্যাতনের শিকার হয়েছে৷ ২০১৪ সালে এই সংখ্যা চার হাজারের বেশি৷ তবে প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হবে, কারণ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ না হলে সে তথ্য তারা পায় না৷
মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘শিশুরা নানা দিক থেকে নির্যাতন এবং বেআইনি ব্যবস্থার শিকার হচ্ছে৷ তাদের যারা বিপথগামী করে তারা আইনের আওতায় আসে না৷ বরং বেআইনিভাবে তাদের শাস্তি দেয়া হয়৷” এ নিয়ে তিনি একাধিকবার হাইকোর্টে রিট করার কথা জানান৷
তিনি জানান, ‘‘অনেক সময়ই পুলিশ শিশুদের বয়স বাড়িয়ে ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ দেখায়৷ সমাজসেবা অধিদপ্তরের ‘প্রবেশন কর্মকর্তারা’ তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন না৷ ফলে শিশু হয়ে যায় প্রাপ্তবয়স্ক৷ এমনকি শিশুদের থানা হাজতে রাখারও নজির আছে৷”
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমাদের সার্বিক সামাজিক এবং আইনি ব্যবস্থা শিশুবান্ধব নয়৷ তারা সবচেয়ে ‘ভালনারেবল গ্রুপ’ হওয়ায় তারা সামজিকভাবে যেমন নিগৃহীত হয়, তেমনি আইনের নামেও তাদের সঙ্গে বেআইনি আচরণ করা হয়৷”
এছাড়া বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমও পর্যাপ্ত ভূমিকা পালন করছে না বলে জানান তিনি৷ তাঁর কথায়, ‘‘আইনে বিপর্যস্ত বা আটক শিশুদের পরিচয় এবং ছবি প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, তা মানছে না সংবাদমাধ্যম৷ ফলে কোনো ‘অপরাধে’ আটক শিশুর ছবি প্রকাশ করে সংবাদমাধ্যম তাকে ‘অপরাধী’ হিসবে সমাজের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তার সংশোধন এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে৷ খবরঃডিডাব্লিউ।
কিশোর ‘অপরাধ’ এবং বাংলাদেশের বাস্তবতা
Share This