অনলাইন ডেস্ক ঃ নিকোলাস মাদুরো কর্মজীবনে প্রবেশ করেন সাধারণ একজন বাস চালক হিসেবে। এরপর তিনি শ্রমিক সংঘের নেতা হন। ২০০০ সালে ভেনেজুয়েলার জাতীয় পরিষদের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুগো চাভেজের সরকারের শাসন আমলে তিনি অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ঘটনা পরম্পরায় ২০০৬ সালে তিনি ভেনেজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। এ সময়ে তাঁকে ‘সবচেয়ে দক্ষ প্রশাসক ও রাজনীতিবিদ হিসেবে চাভেজের সবচেয়ে কাছের ব্যক্তিরূপে’ মনে করা হতো।
৯ আগস্ট, ২০০৬ তারিখে মাদুরো পররাষ্ট্রমন্ত্রীরূপে নিযুক্ত হন। পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে মুয়াম্মার গাদ্দাফি সরকারের কাছ থেকে সুন্দর বৈদেশিক নীতির মাধ্যমে ব্যাপক সহায়তা পান। এছাড়াও, ২০১০ সালের কলম্বিয়া-ভেনেজুয়েলার মধ্যকার বিচ্যুত কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়াস চালান তিনি।
৫ মার্চ, ২০১৩ তারিখে চাভেজের মৃত্যুর পর নিকোলাস মাদুরো ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন এবং রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার কাঁধে নেন। তবে, চাভেজের মৃত্যুর ফলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় আরোহণের মাধ্যমে তিনি ভেনেজুয়েলার সংবিধানের [১৫] ২২৯, ২৩১ ও ২৩৩ নং ধারা ভঙ্গ করেছেন বলে বিরোধী দলীয় নেতারা অভিযোগ তোলেন।
২০১৩ সালের ১৪ এপ্রিল তারিখে অনুষ্ঠিত বিশেষ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি নতুন রাষ্ট্রপতিরূপে অত্যন্ত স্বল্প ১.৫% ভোটের ব্যবধানে সরাসরি নির্বাচিত হন। নির্বাচনে তিনি ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টি’র পক্ষাবলম্বন করে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হন। তাঁর প্রধান ও একমাত্র নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মিরান্ডার গভর্নর হেনরিক ক্যাপ্রিলস। তবে, সাংবিধানিকভাবে তাঁর ক্ষমতায় আরোহন ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের ফলে বিরোধী দল থেকে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়।
তার পরের ঘটনা জানা। শপথ নিয়েছেন রাষ্ট্র পরিচালনার। দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতার পর দেশটির ভাগ্যের চাবি এখন নিকোলাস মাদুরোর হাতে। বিপ্লবী নেতা হুগো শ্যাভেজের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তিনি যথার্থভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় সক্ষম হবেন বলে তার ওপর আস্থা রেখেছেন ভেনেজুয়েলাবাসী।
যারা নিকোলাস মাদুরীর ওপর আস্থা রেখেছেন সেই সমর্থকরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, মাদুরো হুগো চাভেজের আর্দশ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হবেন না। কেননা প্রায় দুইদশক হুগো চাভেজের একান্ত সান্নিধ্য লাভ করে মাদুরো রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষতা বেশ ভালভাবে আয়ত্ব করতে পেরেছেন। তাই মাদুরো অবশ্যই হুগো চাভেজের পথেই হাঁটবেন। মাদুরোর এই শাসনের মাধ্যমে ভেনেজুয়েলা যুক্তরোষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা সত্বেও দেশটির বৈপ্লবিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখবেন।
এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সিরিয়া, ইরান, কিউবাসহ লাতিন আমেরিকার বামপন্থি দেশগুলোর জোটের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরালো করেছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাদুরো অদূর ভবিষ্যতে তার সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যহত রাখতে পারবেন।
এই আশাবাদ নয় শপথ গ্রহণের পরপরই মাদুরোকে ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্যে জোরেসোরে প্রস্তুতি নিতে হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিম্নগতি, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এইসব সংকটকে মোকাবেলা করতে হবে মাদুরোকে।
মাদুরোর প্রতিদ্বন্দ্বী হেনরিক ক্যাপ্রিলেস তার নির্বাচনী প্রচারণায় জানিয়েছিলেন, হুগো চাভেজ তার ১৪ বছরের শাসনামলে জিডিপির দশ ভাগের এক ভাগ তিনি সামাহিক কর্মসূচিতে ব্যয় করেছেন। ক্ষমতায় আসার পর চাভেজ শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনতে শুরু করেছিলেন। কেবল ভেনেজুয়েলার জনগণের জন্যে নয়, তিনি রাজনৈতিক মিত্রদের প্রতি সহনশীল ছিলেন। বিদেশে তার রাজনৈতিক মিত্রদের জন্যে অনুরূপ বদান্যতা দেখিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এই বলে যে, ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির যে অবস্থা তাতে চাভেজের মত এইরূপ বদান্যতা দেখা মাদুরোর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। আবার সামাজিক কর্মসূচিতে চাভেজের মতো জনপ্রিয়তা দেখাতে না পারলে তাতে ভবিষ্যতে জনসমর্থনে ভাটা পড়তে পারে।
বিশ্লেষকেরা দাবি করেছেন, বিশ্লেষকেরা বলছেন, নিকোলাস মাদুরোকে এবার সংস্কারের কাজে মনোযোগ দিতে হবে। কারণ, তাঁকে এখন যেসব কাজের দায়িত্ব নিতে হবে, তা খুব সহজ হবে না।
চাভেজের শাসনামলে দেশটির লাখ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু তিনি ভেনেজুয়েলার অর্থনীতিকে খুব ভালো অবস্থায় রেখে গেছেন তা নয়। দেশটির সংকটের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি ছাড়াও রয়েছে মান্ধাতার আমলের শিল্প-কারখানা, বৈদেশিক ঋণ আর তার মোটা সুদ, তেলের ওপর অতি নির্ভরশীলতা ইত্যাদি। এখনো ভেনেজুয়েলার মোট রপ্তানি আয়ের ৯৬ শতাংশ আসে তেল থেকে। কিন্তু এত বড় তেল উৎপাদনকারী দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভেনেজুয়েলাকে জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়! কারণ, দেশের অনেক পুরোনো তেল শোধনাগারগুলো অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে সমর্থ নয়।
হুগো চাভেজ সে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন মাদুরোকে সেই পথেই থেকেই দেশটির শাসনভার পরিচালনা করতে হবে। মাদুরোকে হতে হবে মুক্তির পথের দিশারী। কঠিন এক পরীক্ষার মধ্যদিয়ে সামনের দিনগুলো এগুতে হবে মাদুরোকে। এই কঠিন পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়া মানে মাদুরোর রাজনৈতিক জীবনের মৃত্যু। মাদুরোর লড়াই আসলে হুগো চাভেজকে ছাপিয়ে যাওয়ার।
সূত্র: বিবিসি