ব্রিটিশ লেখক জে কে রাউলিংয়ের বিশ্বজোড়া খ্যাতি হ্যারি পটার সিরিজের জন্য। ছোটবেলা থেকেই মজার মজার গল্প লিখতেন তিনি, আর সেই গল্পগুলো লেখা শুরু করেছিলেন তাঁর বোনকে পড়ে শোনানোর জন্য। জে কে রাউলিং এখন বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক এবং ব্রিটেনের শীর্ষ ধনী নারীদের মধ্যে ১২তম। ২০০৮ সালের ৫ জুন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন উপলক্ষে তিনি এই বক্তব্যটি দেন।
সমাবর্তন উপলক্ষে বক্তব্য দেওয়া বিশাল একটি দায়িত্ব। আমি আমার সমাবর্তনকে মনে করছি। তখন সমাবর্তন স্পিকার ছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক ব্যারোনেস মেরি ভারনক। তাঁর বক্তব্যের প্রতিফলন আমাকে সাহায্য করেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে আমার লেখায়।
আসলে আমি আমার মন ও হূদয়কে একটি ছকে বেঁধেছিলাম এবং কী শপথ করেছিলাম, তা-ই আজ বলব। আমি আমাকেই জিজ্ঞেস করতাম, কী চাই? ২১ বছরে স্নাতক পাস করেছি, ডিগ্রি অর্জন করেছি, কিন্তু আমি কী শিখেছি আমার শিক্ষাজীবন থেকে? এখান থেকে আমি দুটো উত্তর পেয়েছি। আমাদের একাডেমিক সাফল্য উপলক্ষে যেদিন সবাই একত্র হয়েছিলাম, সেদিন আমি আলোচনা করেছিলাম, আমার সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার মধ্যে আমার লাভ কী? আমার জীবন আর তোমাদের জীবনের মাঝের যে সময়টুকু সেটাই ‘বাস্তব জীবন’। আমি চাই, আমার মতো তোমাদেরও কল্পনার শিখা যেন অনেক উজ্জ্বল হয়।
আমি ফিরে যাচ্ছি আমার ২১ বছর বয়সী জীবনে, যখন সবে গ্র্যাজুয়েশন করেছি। তখন আমি নিজেই আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম। আমি চাইতাম লিখতে, উপন্যাস লিখতে। আমার মা-বাবা দুজনের কেউই কলেজে যাননি। তাঁরা খেয়াল করতেন, আমার উচ্চকল্পনাশক্তি আছে। কিন্তু তাঁরা আশা করতেন, আমি যেন একটি কারিগরি ডিগ্রি অর্জন করি। আর আমি চেয়েছিলাম ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়তে। আমি তখন একটি সমঝোতায় পৌঁছেছিলাম যে কেউই তার অবস্থানে খুশি নয়। তারপর আমি আধুনিক ভাষা নিয়ে পড়া শুরু করলাম।
আমি মনে করতে পারি না যে আমার মা-বাবা কখনো বলেছেন, আমি ভালো পড়াশোনা করি। আমি যেদিন গ্র্যাজুয়েশন পূর্ণ করি, সেদিনই হয়তো তাঁরা প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন, আমি পড়াশোনা করি। আমি আমার মা-বাবার দৃষ্টিকোণকে দোষ দিই না। যদি তোমার হাতে স্টিয়ারিং থাকে এবং তুমি ভুল পথে যাও, তখন তোমার মা-বাবাকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। কারণ স্টিয়ারিং তো তোমার হাতেই ছিল। আমার মা-বাবা গরিব ছিলেন, ফলে আমিও। তাঁদের সঙ্গে আমি একমত, দারিদ্র্য খারাপ কোনো অভিজ্ঞতা নয়। দরিদ্রতার মধ্যে আছে ভয়-ভীতি, কষ্ট আর হতাশা। এই দরিদ্রতাকে জয় করতে হয় নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে। এটা যখন প্রয়োজন ঠিক তখনই হতে হবে। মনে রাখা উচিত, বোকাদের কাছে দরিদ্রতা রোমাঞ্চকর হতে পারে, তোমার কাছে নয়।
আমি তোমাদের বয়সে ইউনিভার্সিটি থেকে অনেক দূরে একটা কফিশপে বসতাম আমার গল্প লেখার জন্য। ক্লাসেও মনোযোগ দিতাম লেকচারের প্রতি। পরীক্ষায় পাস করার পর প্রতিবছরই আমি আমার সাফল্যের কথা হিসাব করতাম।
আমি জানি, তোমরা এখন প্রাপ্তবয়স্ক, এখন উচ্চশিক্ষিত। তো সেই তোমরা কঠোর পরিশ্রম করতে পারবে না, তা আমি মানি না। বুদ্ধিমত্তা কখনোই ভাগ্যের কারণে ব্যর্থ হতে পারে না এবং আমি এক মুহূর্তের জন্যও তা মনে করিনি। তোমরা হার্ভার্ড থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছ, তোমরা ব্যর্থতার সঙ্গে ততটা পরিচিত নও। সফল হওয়ার ইচ্ছার সঙ্গে ব্যর্থতা সম্পর্কেও তোমাদের একটু হলেও ধারণা থাকা ভালো। প্রকৃত পক্ষে, ব্যর্থতা সম্পর্কে তোমাদের ধারণা আর একজন মানুষের সফলতা সম্পর্কে ধারণা খুব বেশি দূরের নয়।
একসময় আমার জীবনটা অন্ধকারে ছিল। আমার কোনো ধারণা ছিল না, কী হচ্ছে বা কী হতে যাচ্ছে। আমার ধারণা ছিল না, এই অন্ধকারের খালটি কত বিস্তৃত হবে। তবে কেন জানি মনে হতো, একটি দিক থেকে হয়তো আলো আসবে।
আমি নিজের ওপর বিশ্বাসের জোরটাকে বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমি আমাকে বোঝাতে চাইতাম, আমি কী। তার পর থেকে আমি সরাসরি আমার শক্তি বা সামর্থ্যকে ব্যবহার করেছি কোনো কাজের ভালো একটা ইতি টানতে। আমি বিশ্বাস করতাম, আমি যেকোনোভাবেই সফল হব। আমার সাফল্য কখনোই কোনো নির্দিষ্ট একটা পথ বেয়ে আসেনি। আমি বিশ্বাস করতাম, আমি সত্যিকার অর্থেই আমার সঙ্গে আছি। আমি নিজেকে মুক্ত করেছিলাম। কারণ আমার ছিল নিজেকে চেনার বিশাল এক ক্ষমতা। আমি বিশ্বাস করতাম আমাকে। আমি আমার নিম্নবিত্ত মা-বাবার মেয়ে ছিলাম। আমার একটি পুরোনো টাইপ রাইটার ছিল এবং এর সঙ্গে ছিল বড় একটা স্বপ্ন। এ বাস্তবতাই আমাকে নতুন করে, সক্ষম করে গড়ে তুলেছে।
আর আমার ছিল কল্পনা করার ক্ষমতা। এটার একটা অংশই আমাকে পুনরায় গড়তে সহায়তা করেছে, কিন্তু পুরোটা নয়। আমি শিখেছি, বিশাল এক অনুভূতির মধ্যে কল্পনার বা কল্পনাশক্তির কী মূল্য। কল্পনাশক্তিই আবিষ্কার আর অনাবিষ্কারের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয়। কল্পনাশক্তি যদি প্রবল হয়, তবে সফল হওয়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে, করতে হবে এর যথাযথ ব্যবহার। সবাই পারে না। যারা পারে তারাই সফল। সুতরাং তুমি নিজেই ঠিক করো, তুমি কোন দলে থাকবে।
আমার সফলতম অভিজ্ঞতা হলো হ্যারি পটার। আমি একনাগাড়ে, পর্যায়ক্রমে লিখে গেছি বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। আর এই বিশাল কর্মযজ্ঞটি শুরু হয়েছিল আমার চাকরির শুরুর দিকে। আমি তখন চাকরি করতাম লন্ডনের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদর দপ্তরে আফ্রিকান গবেষণা বিভাগে। অফিসে প্রতিদিন অসংখ্য চিঠি আসত, যেখানে থাকত কী ঘটছে সেখানে, আর ঘটনাগুলো যেন সারা বিশ্ব জানতে পারে। আমি তাদের ভয়ানক ছবি দেখেছিলাম। আমি সেসব মানুষের অত্যাচারের ছবি দেখেছি।
প্রায় প্রতিদিনই আমি মানুষের ওপর মানুষের নির্যাতনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। মানুষ হয়ে তারই স্বজাতি মানুষের ওপর আঘাত করতে কুণ্ঠিত হয় না। এবং এখন পর্যন্ত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল থেকে অনেক কিছু শিখছি, যা এর আগে কখনো শুনিনি, শিখিনি।
যা-ই হোক, আমার সর্বশেষ আশার কথাটি বলছি। আমি যখন ২১ বছরে ছিলাম, তখনকারই কথা। যাদের সঙ্গে আমি গ্র্যাজুয়েশনের দিন একসঙ্গে বসেছিলাম, তাদের অনেকেই আজ তাদের নিজ গুণে মানবসেবা এবং মানুষের জন্য কাজ করছে। অনেকেই শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। তারা অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছে। মানুষের জন্য মৃত্যুভয়কেও হটিয়ে দিয়েছে। আমাদের গ্র্যাজুয়েশনে আমরা প্রচুর আশার মধ্যে আবদ্ধ ছিলাম, যা আমাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে হয়েছিল। এ রকম কখনোই আর আসবে না।
সুতরাং আজকের দিনে তোমাদের মধ্যে সে রকম বন্ধুত্ব ছাড়া বেশি কিছু থাকার কথা নয় এবং আগামীকাল আমি আশা করি, যদি তুমি আমার একটি শব্দও মনে রাখো, তবে একটু হলেও সাহস পাবে সামনে চলার। যদি এটা গল্পের মতো হয়, তবে এটাই জীবন। সেটা কত দীর্ঘ, তা নয়, কত ভালো এটাই হচ্ছে বিষয়।
(ইন্টারনেট থেকে নেওয়া)