অপূর্ব লাল সরকার, গৌরনদী (বরিশাল) থেকে ফিরেঃবরিশালের কীর্তনখোলা ও মেঘনা নদীসহ হাট-বাজার থেকে আটককৃত জাটকা ইলিশ গায়েব হয়ে যাচ্ছে। একটি সংঘবদ্ধ চক্র আইনশৃক্সখলা বাহিনীর অভিযানের নাম করে দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীবাহী লঞ্চগুলোতে প্রতিরাতেই মাছ আটকের জন্য তল্লাশি চালিয়ে নামিয়ে নিচ্ছে ঝুঁড়ি ঝুঁড়ি ইলিশ। সেইসব ইলিশ প্রকাশ্যেই বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে বলে বিভিন্নসূত্র থেকে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ যাবৎ একাধিক আটক ইলিশের চালান গায়েব করা হয়েছে। কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তারাও ইলিশ গায়েবের সাথে জড়িত রয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
সূত্রমতে, জাতীয় মৎস্য সম্পদ ইলিশ সংরক্ষণে মার্চ ও এপ্রিল দু’মাসে মেঘনায় জাটকাসহ মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং ক্রয়-বিক্রয় আইনত: দন্ডনীয় অপরাধ বলে ষোষণা করেছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। তারপরেও অধিক মুনাফালোভী জেলেরা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে জাটকাসহ ইলিশ শিকারের মহোৎসবে মেতে উঠেছে। তাদের সাথে বাড়তি আয়ের জন্য আটক বাণিজ্যে নেমেছেন মৎস্য অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা ও পুলিশ। এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঠিক মনিটরিং না থাকায় সরকারের মহতী উদ্যোগ কোন সুফল বয়ে আনছেনা।
বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১৫ এপ্রিল বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর বিভিন্নস্থানে যাত্রীবাহী লঞ্চ ও স্পীডবোটে অভিযান চালিয়ে ১২০ কেজি জাটকাসহ দু’জনকে আটক করে কোস্টগার্ড সদস্যরা। এরপূর্বে গত ১২ এপ্রিল ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের কাশীপুর নামকস্থান থেকে যাত্রীবাহী বাস থেকে ৩৫ হাজার টাকা মূল্যের ১৬০ কেজি জাটকা ইলিশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ১০ এপ্রিল বরিশালের তেঁতুলিয়া নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ঢাকাগামী যাত্রবাহী লঞ্চে অভিযান চালিয়ে ১২০০ কেজি জাটকা ইলিশ উদ্ধার করে পুলিশ ও মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা। এসময় জাটকা বহনকারী চারটি লঞ্চ থেকে বিশ হাজার টাকা জরিমানাও আদায় করা হয়। অপরদিকে ১১ এপ্রিল ভোরে পরিবহনযোগে ১৬০ কেজি জাটকা পাচারের সময় গৌরনদী হাইওয়ে থানা পুলিশ কুব্বত আলী শেখ নামের এক মৎস্য ব্যবসায়ীকে আটক করেন। এঘটনার পরই বেড়িয়ে আসতে থাকে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। নগরীর কীর্তনখোলা নদীর চরকাউয়া ফেরী ঘাট এলাকা থেকে ১০ এপ্রিল গভীর রাতে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিমল চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ জাটকা ইলিশ আটক করা হয়। আটক জাটকাগুলোকে হরিলুটের জন্য ওই রাতেই নগরীর ভাটারখাল কলোনীর জেটিতে আনা হয়। সেখানে বসে মেট্রোপলিটন পুলিশের কতিপয় অফিসার ও কনস্টবলেরা মৎস্য কর্মকর্তার সাথে আলাপ করে সিংহভাগ ইলিশ ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়ে যায়। বাকি ১৬০ কেজি ইলিশ মৎস্য কর্মকর্তা বিমল চন্দ্র দাস স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতার সহায়তায় মৎস্য ব্যবসায়ী কুব্বত আলী শেখের কাছে বিক্রি করে দেন। এদিকে এলাকার সচেতন মানুষেরা সরকারের মহতী উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে হাট-বাজারে জাটকা ইলিশ বিক্রি বন্ধ ও ক্রয়ে বাঁধা সৃষ্টি করলেও এখানে পুরোপুরি বাঁধ সেঁধেছেন বাড়তি আয়ের ধান্ধায় নামা ওইসব অসাধু কর্মকর্তারা। সূত্রমতে, গত ১৮ এপ্রিল সকালে জেলার গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের কমলাপুর বাজারে তিনটি ব্যারেলে প্রায় ৬০ কেজি জাটকা ইলিশ বিক্রির সময় এক ব্যবসায়ীকে আটক করে বাজারের স্থায়ী ব্যবসায়ীরা। পরবর্তীতে জব্দকৃত জাটকাসহ আটক ব্যবসায়ীকে থানার এএসআই মকবুল হোসেনের কাছে সোর্পদ করা হয়। মাত্র দশমিনিটের ব্যবধানে পুলিশের ওই কর্মকর্তাকে মোটা অংকের টাকা উৎকোচ দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় কতিপয় সুবিধাভোগীরা। এ সুযোগে জব্দকৃত জাটকাগুলো একই এলাকার আজাহার তালুকদার, এমরান ফকির, জাহাঙ্গীর ঘরামী, মনির হোসেন, ফিরোজ তালুকদার, সেলিম মেম্বারসহ অন্যান্য সুবিধাভোগীরা লুটপাট করে নিয়ে যায়। এনিয়ে জাটকা আটক ব্যবসায়ীদের সাথে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয়া উল্লেখিত সুবিধাভোগীদের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।
অপর একটি সূত্রে জানা গেছে, আইনশৃক্সখলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে যাত্রীবাহী লঞ্চে মাছের চালান আটক অভিযানের সময় তাদের সঙ্গে মৎস্য ব্যবসায়ীদের ভাড়া করা ব্যক্তি মালিকানার কয়েকটি স্পীডবোট নিয়ে যাওয়া হয়। আটক মাছের চালান নদীতে বসেই পানির দরে বিক্রি করে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে অভিযান পরিচালনাকারী ওই চক্রটি। এভাবে প্রায় প্রতিদিন রাতেই আটক ইলিশ লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক মৎস্য আড়তদাররা জানান, সংশ্লিষ্ট মৎস্য বিভাগ ও আইনশৃক্সখলা বাহিনীর কতিপয় অফিসারদের প্রত্যক্ষ যোগসাজসে জাটকা নিধন এবং পাচার বন্ধ হচ্ছেনা। যে কারণে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সুফল বয়ে না এনে বরং বদনাম হচ্ছে। এব্যাপারে পুলিশ সুপার একেএম এহসান উল্লাহ বলেন, কোন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস নিজের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে তার অফিসে চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, আটক ইলিশ এতিমখানা ও গরীবদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। তবে বিশেষ একটি সূত্রে জানা গেছে, নদীতে মৎস্য অধিদপ্তর, পুলিশ ও কোস্টগার্ডসহ কয়েকটি আইনশৃক্সখলা বাহিনী অভিযান পরিচালনা করছেন। এরমধ্যে মিডিয়া এবং জনসমক্ষে শুধুমাত্র কোস্টগার্ডের অভিযানের আটক ইলিশের স্বচ্ছতা রয়েছে। অন্যসব সংস্থার কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের আটক বানিজ্যের কারণে বরিশালের মেঘনাসহ অন্যান্য নদীগুলোতে জেলেরা অবাধে জাটকা ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরার মহোৎসবে মেতে উঠেছে।